spot_imgspot_img
spot_imgspot_img

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষ : গুলিতে নিহত ৫

spot_img

 

- Advertisement -

প্রিয় সংবাদ ডেস্ক :: চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারায় নির্মাণাধীন একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে শনিবার সকালে পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৫ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক শ্রমিক ও কয়েকজন পুলিশ সদস্য। আহতরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সংঘর্ষের সময় ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়েকটি স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়, চালানো হয় ভাঙচুর।

বেতন-ভাতার দাবিতে আন্দোলনের কথা বলা হলেও পরিকল্পিতভাবে শ্রমিক উসকানির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছে পুলিশ। আর কর্তৃপক্ষ বলছে, স্বার্থ হাসিলের জন্য একটি চক্র অপতৎপরতা চালিয়েছে। নিহতদের পরিবারের জন্য তিন লাখ ও আহতদের জন্য ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার। ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সম্প্রতি ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে শ্রমিক সরবরাহের কাজ গন্ডামারা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক লিয়াকত আলীকে না-দিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানকে দেয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ উঠেছে, এতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে শ্রমিকদের উসকে দিয়েছেন।

সংঘর্ষে নিহতরা হলেন : গন্ডামারা ইউনিয়নের মাওলানা আবু ছিদ্দিকের ছেলে আহমদ রেজা (৩০), কুমিল্লার চান্দপুর উপজেলার নজরুল ইসলামের ছেলে শুভ (২৬), চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থানার অলি উল্লাহর ছেলে রনি (২৮), কিশোরগঞ্জের মিঠামাইন উপজেলার ফালু মিয়ার ছেলে মাহামুদুল হক রাহাত (৩২) ও রায়হান (২৫, তাৎক্ষণিকভাবে বিস্তারিত পরিচয় মেলেনি)।

আহতদের মধ্যে তিন পুলিশ সদস্যসহ ১৭ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন এদের কেউ পায়ে, কেউ হাতে, কেউ বুকে গুলিবিদ্ধ। সবাইকে ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে রয়েছেন-গন্ডামারার হাবিব উল্লাহ, রাহাত, মিজান, মুরাদ, মো. শাকিল মো. কামরুল ইসলাম, মাসুদ আহমেদ, আমিনুল হক, মো. দিদার, ওমর ফারুক, অভি, কায়সার এবং পুলিশ কনস্টেবল আবদুল কাদির, ইয়াসির আরাফাত ও আসাদুজ্জামান।

শ্রমিকরা জানান, বেতন-ভাতা ও রমজান মাসে কাজের সময় কমানোর দাবিতে শ্রমিকদের সঙ্গে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লোকজনের কথা কাটাকাটি হয়। এর জের ধরে ওই সংঘর্ষ বাধে।

পুলিশ জানায়, হঠাৎ করে বেতন-ভাতার দাবিতে কিছু শ্রমিক ও বহিরাগত মিলে সকাল ৯টার দিকে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ঘেরাও করে। এক পর্যায়ে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ শুরু করলে সংঘর্ষ বাধে পুলিশের সঙ্গে। গুরুতর আহতাবস্থায় অন্তত ৩০ জনকে বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এর মধ্যে পাঁচজনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চিফ কো-অর্ডিনেটর ফারুক আহমেদ বলেন, ‘লোকাল কিছু ইন্ধন রয়েছে। না-হলে এমন ঘটনা ঘটার কোনো কারণ ছিল না।’ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলছেন, এ ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক। স্থানীয় একটি দুষ্টচক্র নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য শ্রমিকদের অযথা উসকে দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ বারবার বন্ধ করে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত। আকিজ উদ্দিন নামে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘একটা রাজনৈতিক দৌরাত্ম্য এখানে কাজ করছে। তা না-হলে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা শ্রমিকদের হাতে অস্ত্র থাকার কথা নয়।’

দুপুরে ঘটনাস্থলে আসেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান ও পুলিশ সুপার এসএম রশিদুল হকসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা। পুলিশ সুপার বলেন, ‘বিদ্যুৎ কেন্দ্রে শ্রমিকরা যে দাবিগুলো জানিয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটি দাবি বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছিল। তবে রমজান মাসে কাজের সময় কমানোর দাবিতে শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠায় তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন শ্রমিকরা। এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে নিহত শ্রমিকদের পরিবারপ্রতি তিন লাখ টাকা এবং আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।

জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান বলেন, ‘গন্ডামারায় নির্মিতব্য এ কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আমাদের দেশের অন্যতম একটি সম্পদ। স্থানীয় কিছু উন্নয়নবিদ্বেষী কুচক্রী মহলের উসকানিতে শ্রমিকরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডবিরোধী ওই চক্রটির সদস্যদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। ঘটনা তদন্তে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চার ও তিন সদস্যের দুটি পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

যোগাযোগ করা হলে গন্ডামারা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী শনিবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, ‘এ ঘটনায় আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের একটি ও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের অন্যতম বৃহৎ এ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এ বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয়েছিলেন চার বিক্ষোভকারী। এর কিছুদিন পর আবারও সংঘর্ষে নিহত হন আরও একজন।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি বিএলএফের : বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশন (বিএলএফ) চট্টগ্রাম জেলা শাখা শনিবারের ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছে। এদিন নগরীর ওয়াসা মোড়ের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জরুরি সভা থেকে এ দাবি জানানো হয়। জেলা কমিটির সভাপতি সৈয়দ রবিউল হক শিমুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সংগঠনের মহানগর কমিটির সভাপতি আনোয়ার হোসেন। জেলা সাধারণ সম্পাদক মাঈন উদ্দিনের সঞ্চালনায় সভায় বক্তব্য দেন আবু আহমেদ মিয়া, নুরুল আবছার তৌহিদ, এয়াছিন মিয়াজি, আবুল ফয়েজ, ইউছুফ, মো, হাসানা, নুরুল আলম, জাবেদ চৌধুরী প্রমুখ। আনোয়ার হোসেন বলেন, পবিত্র রমজান মাসে শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও হত্যার ঘটনা অমানবিক। এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে।

ঢাবিতে ছাত্রফ্রন্টের প্রতিবাদ সমাবেশ : ঢাবি প্রতিনিধি জানান, শ্রমিকদের ওপর গুলি চালানোর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট শনিবার প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। সংগঠনের সভাপতি আল কাদেরী জয়ের সভাপতিত্বে এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক শোভন রহমানের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য দেন সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্স ও ঢাকা মহানগরের সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ। সমাবেশ শেষে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রফ্রন্টের যৌথ মিছিল রাজু ভাস্কর্য, ঢাবি লাইব্রেরি ও ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে টিএসসিতে গিয়ে শেষ হয়। এরপর ছাত্রফ্রন্টের উদ্যোগে কমিউনিটি কিচেন থেকে তৃতীয় দিনের মতো দুস্থ, শ্রমজীবী ও ছিন্নমূল মানুষের জন্য খাবার সরবরাহ করা হয়। সমাবেশ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জড়িতদের বিচারের দাবি জানানো হয়। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া মেনে না-নিলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।

ছাত্র ইউনিয়নের নিন্দা : বাঁশখালীতে শনিবারের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদ। সংসদের সহসভাপতি নজির আমিন চৌধুরী জয় ও সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাগীব নাঈম বিবৃতিতে বলেন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গোটা দেশের অর্থনীতিকে যে শ্রমিকরা টিকিয়ে রেখেছেন, তাদের ওপর গুলি চালানোর পরিণাম কোনোভাবেই সুখকর হবে না।

spot_imgspot_img
spot_imgspot_img

সর্বশেষ