ঈদ আসার আগেই অস্থির বাংলাদেশের মসলার বাজার

কুরবানির ঈদের আগে পশুর ঊর্ধ্বমুখী দামের মধ্যে এবার আগুন লেগেছে মসলার বাজারেও। বিশেষ করে গত বছরের ঈদের সাথে তুলনা করলে কিছু কিছু মসলার দাম দুই থেকে পাঁচ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভালো মানের জিরা ও আদার দাম।

- Advertisement -

জিরা, আদা, রসুন
জিরার দাম মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। এছাড়া রসুন, হলুদ, মরিচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, এলাচসহ অন্য মসলার দামও চড়া। গত কয়েক মাস ধরেই মসলার বাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। রোববার ঢাকার বনানী কাঁচাবাজার ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

বর্তমানে পাইকারি বাজারে জিরা বিক্রি হচ্ছে ৮৮০ থেকে ৯৫০ টাকা কেজি দরে।

খুচরা বাজারে প্রতি কেজি জিরার দাম হয়ে যাচ্ছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা। অথচ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, ২০২২ সালের ২২ জুন প্রতি কেজি জিরা সর্বনিম্ন ৩৮০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে জিরার দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।

দেশী ও আমদানি করা আদার পাইকারি দরও বেড়েছে কয়েক গুণ। বর্তমানে আমদানি করা আদা পাইকারি বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ২৮০ টাকা দরে। খুচরা বাজারে তা হয়ে যাচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৩০ টাকার মতো।

দেশী আদারও বর্তমানে পাইকারি দর ৩৫০ টাকা কেজি এবং খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা কেজি দরে।

টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের এ সময়ে আমদানি করা আদা মান ভেদে কেজি প্রতি ৬০ থেকে ১০০ টাকায় এবং দেশী আদা ১২০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

অর্থাৎ বছর ব্যবধানে আদার দাম তিন থেকে পাঁচগুণ বেড়েছে।

রসুনের দামও বাড়তি। আমদানি করা রসুন পাইকারি বাজারে কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা দরে। খুচরা বাজারে দাম ধরা হয়েছে ১৮০ টাকা কেজি।

দেশী রসুনের পাইকারি দর কেজি প্রতি ১২০ টাকা এবং খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়। মান ভেদে কোনো কোনো রসুন ১৮০ টাকা কেজিও দাম হাঁকতে দেখা গিয়েছে।

এক বছর আগে টিসিবির হিসাবে দেশী রসুন বিক্রি হয়েছিল ১১০ থেকে ১৪০ টাকায় এবং আমদানিকৃত রসুনের দাম ছিল কেজি প্রতি ৭০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ ক্ষেত্রভেদে রসুনের দামও দ্বিগুণ বেড়েছে।

মরিচ, হলুদ ও অন্য
শুকনা মরিচের ঝাল ছাড়িয়ে গেছে দামে।

ব্যবসায়ীরা জানায়, পাইকারি বাজারে আমদানি করা লাল মরিচ ৪০০ থেকে ৪২০ টাকা কেজি দরে এবং খুচরা বাজারে লাল মরিচ ৪৫০ থেকে ৪৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

দেশী মরিচের পাইকারি দর ৩৮০ টাকা এবং খুচরা বাজারে ৪৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখা যায়। অথচ এক বছর আগেও দেশী শুকনা মরিচ বিক্রি হয়েছে ২২০ থেকে ২৭০ টাকায়। আমদানি করা শুকনা মরিচের দাম পড়ত ৩২০ থেকে ৩৬০ টাকা।

এখানে মরিচের দামও বছর ব্যবধানে দ্বিগুণ বেড়েছে।

হলুদের দামও অনেকটা বেড়েছে। দেশী হলুদের কেজি প্রতি পাইকারি দর ২৫০ টাকা এবং খুচরা দাম ৩০০ টাকা। আমদানি করা হলুদের পাইকারি দাম ২০০ টাকা এবং খুচরা দাম ২৩০ টাকা কেজি।

গত বছরের এ সময়ে দেশী হলুদের দাম ছিল ১৫০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে এবং আমদানি করা হলুদের দাম ছিল আরো কম ১৬০ থেকে ২৪০ টাকার মধ্যে।

ওই হিসেবে হলুদের দামও দ্বিগুণের কাছাকাছি বেড়েছে।

একই সাথে ধনে, লবঙ্গ, দারুচিনিসহ দাম বেড়েছে বেশ কিছু মশলার।

প্রতি কেজি দারুচিনি ৪৬০ থেকে ৫২০ টাকায়, লবঙ্গ দেড় হাজার থেকে এক হাজার ৬০০ টাকায়, ধনে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আর টিসিবির হিসাবে বছরখানেক আগে দারুচিনি ৪০০ থেকে ৪৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। লবঙ্গ এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকায় এবং ধনে ১৩০ থেকে ১৬০ টাকায়।

পেঁয়াজ আমদানি শুরু হওয়ায় বাজারে আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম অনেকটাই নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। ভারতীয় পেঁয়াজ খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে।

দেশী পেঁয়াজের দাম এখনো খুব একটা কমেনি। পাইকারি বাজারে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে।

অথচ টিসিবির হিসাবে এক বছর আগে দেশী পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছিল। হিসেবে দেশী পেঁয়াজের দাম ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে।

তবে আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম গত বছরের চাইতে এবার কেজিতে অন্তত ১০ টাকা কমেছে।

কারণ ও প্রভাব
মসলার বাজারে এ অস্থিরতার জন্য আমদানিকারকরা ডলার সঙ্কটের কারণে প্রয়োজন মতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারা এবং এ কারণে চাহিদা মতো মসলা আমদানি করতে না পারাকে দায়ী করছেন।

চট্টগ্রামের এক আমদানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বড় আমদানিকারকরা এলসি খুলতে পারলেও মাঝারি আমদানিকারকদের ডলার সঙ্কটের কথা বলে চাহিদা অনুসারে এলসি খুলতে দিচ্ছে না ব্যাংকগুলো।

প্রয়োজন মতো এলসি খুলতে না পারায় চাহিদা মতো আমদানি করা যাচ্ছে না। এজন্য দাম বেশি বলে তিনি জানান।

এছাড়া ডলারের মান কমে যাওয়ায় আমদানি খরচ বেড়েছে।

গত বছর এক ডলারের বিপরীতে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা খরচ হতো। এখন সেখানে আমদানিকারকদের খরচ হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকার মতো। একই সাথে আন্তর্জাতিক বাজারেও কিছু কিছু মসলার দাম বেড়েছে বলে তিনি জানান।

তাছাড়া সারের খরচ, পরিবহনের জ্বালানি ও শ্রমিকের মজুরি বাড়ায় দেশীয় মসলার উৎপাদন খরচও বেড়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলছে, এবারে হাতেগোনা কয়েকটি দেশ থেকে মসলা আমদানি হওয়ায় সরবরাহে টান পড়েছে।

মসলার দাম বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি কমে যাওয়ার কথা জানায় তারা।

বনানী কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বলেন, ‘বেচা-বিক্রির অবস্থা ভালো না। ঈদের মার্কেটে কাস্টমার সামলে কথা বলার সময় পেতাম না। এখন দেখেন মার্কেট খালি। আমরা কী করব? মসলার দাম বেশি বলেই আমাদের বেশি রাখতে হয়। কাস্টমাররাও বাড়তি দামে কিনতে বাধ্য। আগে যে কিনত এক কেজি, এখন সে কিনে ২৫০ গ্রাম। যে কিনত ২৫০ গ্রাম, সে কিনে ৫০ গ্রাম।’

সাধারণত কুরবানির ঈদ এলে গোশতসহ আরো নানা ধরনের খাবার রান্না হয়, যার জন্য ঈদকে কেন্দ্র করে মসলার চাহিদা বেড়ে যায়।

কিন্তু সব মসলার দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়া দুশ্চিন্তায় ফেলেছে ভোক্তাদের।

বনানী বাজারে আসা ক্রেতারা বলছে, স্থানীয় প্রশাসনের সঠিক দর মনিটরিং জোরদার করা গেলে দাম কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে।

পেশায় গাড়িচালক মো: রুবেল হোসেন বলেন, ‘আমি তো বড় চাকরি করি না, এরপরো প্রতিবছর কুরবানি দিতাম। এবার তার সামর্থ্য নেই। জিনিসপত্রের এত দাম। বাসায় যে গোশত আসবে, তা রান্না করার মসলারও দাম বেশি। আয় তো বাড়েনি। হিসাব মিলাতে পারি না।’

গোশতের পাশাপাশি মসলাও যে কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলবে এমনটা ভাবতেও পারেননি চাকরিজীবী ফারহানা হুদা। বাধ্য হয়ে চাহিদার চেয়ে কম কিনে সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘আগে তো চাল, ডাল, মাছ, গোশতের দাম নিয়ে টেনশন করতাম। এখন রান্নার মসলার দামও এত বেশি। গত বছরের চাইতে অন্তত ২০ থেকে ৩০ শতাংশ দাম বেশি। এজন্য আগে যেখানে ধরেন ৫০০ গ্রাম কিনতাম, সেটা এখন আড়াইশ গ্রাম কিনছি। যতটা কম ব্যবহার করা যায়। আদা, জিরা অতিরিক্ত বেড়েছে। এত দাম দিয়ে সম্ভব হচ্ছে না।’
সূত্র : বিবিসি

সর্বশেষ