spot_imgspot_img
spot_imgspot_img

মেকানিকের হাতে যেন ‘জাদুর কাঠি’, দু’যুগে হাজার কোটি টাকার সম্পদ

spot_img

একসময় ছিলেন সরকারি পাবলিক হেলথের অস্থায়ী টিউবওয়েল মেকানিক। সেখান থেকে হঠাৎ বদলে গেছে তার ভাগ্যের চাকা৷ দুই যুগে তিনি হয়েছেন হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক। চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে গড়েছেন প্লট-ফ্ল্যাট। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন প্রায় ১৫টি। কিন্তু তার এসব অর্জন বৈধ পথে হয়নি। তার আয়কর তথ্য বিবরণীতে দেখানো হয়নি এসব সম্পদ, একইসঙ্গে ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণের রাজস্বও৷ তার এসব অবৈধ অর্জনের বিস্তর অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।

- Advertisement -

বলছিলাম খাগড়াছড়ির বাসিন্দা মো. সেলিমের কথা। তবে তার বর্তমান ঠিকানা চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায়।

গত ৩ সেপ্টেম্বর দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১ এর বরাবরে এই অভিযোগ দেওয়া হয়।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, খাগড়াছড়িতে একসময় সরকারি পাবলিক হেলথের টিউবওয়েল মেকানিক হিসেবে বেশ সুপরিচিত ছিলেন সেলিম। এরপর তিনি ঠিকাদারি ব্যবসায় নামে। কিন্তু তার ভাগ্য বদলায় মাদক, ইয়াবা ও হুন্ডি ব্যবসায় জড়িয়ে। এভাবে টাকা কামিয়ে নামে-বেনামে গড়েছেন অন্তত ১৫টি প্রতিষ্ঠান। নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাব ছাড়াও যৌথভাবে করা ঠিকাদারি ব্যবসায়ীদের নামে হিসাব খুলে করেছেন অস্বাভাবিক লেনদেন। তার সম্পদের পরিমাণ ও আয়ের প্রকৃত তথ্য গোপন করে প্রতিবছর কোটি টাকা সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন।

খাগড়াছড়িতে যত সম্পদ ও ব্যবসা

অভিযোগে বলা হয়, খাগড়াছড়িতে রয়েছে মেহেরুন্নসা ফিলিং স্টেশন (পেট্রোল পাম্প)। সেখানে তেল সংরক্ষণ করার মেশিন ও নিজস্ব তেলবাহী লরিও রয়েছে। এসব সম্পদের বাজারমূল্যে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। এসব স্থাপনা থেকে বছরে সেলিমের আয় অন্তত দুই কোটি টাকা।

খাগড়াছড়িতে চারতলার আবাসিক হোটেল ‘ইকোছড়ি ইন’ ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসা রয়েছে সেলিমের। এসব স্থাপনার বাজারমূল্যে প্রায় চার কোটি টাকা। এই খাত থেকে তার বছরে আয় প্রায় এক কোটি টাকার কাছাকাছি।

খাগড়াছড়ির সদর এলাকায় রয়েছে তার ‘সেলিম ট্রেড সেন্টার’ নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এই মার্কেটে আরও রয়েছে তার নিজস্ব আবাসিক হোটেল হিল প্যারাডাইস। এসব খাত থেকে বছরে আয় কোটি টাকা।

এছাড়া সরকারি নীতি না মেনে খাগড়াছড়িতে সেলিমের রয়েছে অন্তত ছয়টি ব্রিক ফিল্ড। সেখানে পরিবেশ দূষণ করার অভিযোগে অভিযান পরিচালনা করে বেশ কয়েকবার জরিমানা করা হয়। এসব স্থাপনার বাজারমূল্যে প্রায় ১০ কোটি টাকা। এই খাত থেকে বছরে আয় কয়েক কোটি টাকা। এসব আয়ের তথ্য আয়কর বিবরণীতে গোপন করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় অন্তত ৩০০ একর জায়গায় রয়েছে রাবার ও আমের বাগান। প্রতি একর জায়গার মূল্যে এক লাখ টাকা হিসেবে জায়গার মূল্য দাঁড়ায় অন্তত ৩০ কোটি টাকা। এছাড়া একই জেলার কৈবল্যটিলাতে ১০০ একর জায়গায় রয়েছে রাবার ও আম বাগান। যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা।

খাগড়াছড়ির বায়তুশ শরফ মসজিদ রোড এলাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালামাল সংরক্ষণের জন্য সেলিমের রয়েছে সাততলা আবাসিক ভবন। ওই ভবনে বিশাল একটি অংশে রয়েছে তার গোডাউন। এই স্থাপনার বাজারমূল্যে প্রায় ১০ কোটি টাকা।

কক্সবাজারে শত কোটি টাকার জায়গা

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, কক্সবাজার ইনানী বিচ সংলগ্ন মেরিন ড্রাইভ রোডের আর্মি রিসোর্টের পাশে সেলিমের রয়েছে ছয় একর জায়গা। যার বাজার মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এছাড়া কক্সবাজার সমুদ্র তীরবর্তী ৫০০ মিটার দূরত্বে রয়েছে তার একটি রিসোর্ট। এখান থেকে তার বছরে আয় প্রায় ৬০ লাখ টাকা। প্রতিবছর আয়কর বিবরণীতে এসব তথ্য গোপন করা হয়েছে।

কোটি কোটি টাকার প্লট-ফ্ল্যাট ঢাকা-চট্টগ্রামে

অভিযোগে বলা হয়, চান্দগাঁও থানার সিডিএ আবাসিক এলাকার ৮ নম্বর রোডে ডি-১৪ নম্বরে বাড়ি, একই এলাকার ১ নম্বর রোডে ব্লক-বি’তে রয়েছে ৫১০ নম্বর এবং ৫০৬ নম্বর দুটি বাড়ি, চান্দগাঁও চন্দ্রিমা আবাসিক এলাকার ১ নম্বর রোডে সাড়ে সাততলা একটি বহুতল ১৯ নম্বর বাড়ি, বায়েজিদ থানার চক্রোস কানন ১ নম্বর রোডের ১৮ ও ১৯ নম্বর প্লটে রয়েছে ছয়তলার একটি বহুতল ভবন, খুলশী থানার উত্তর খুলশীর ৩/এ প্রসাদ বৈশাখী বাড়ি নম্বর ১০/বি-২ তে রয়েছে দুটি ফ্ল্যাট।

এছাড়া চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) আওতায় নগরীর অনন্যা আবাসিক এলাকায় সেলিমের রয়েছে নামে-বেনামে অন্তত চারটি প্লট। যার বাজারমূল্যে আট কোটি টাকা। চট্টগ্রামের হাটহাজারী বড়দীঘির পাড় এলাকায় রয়েছে তার এক একরের একটি জায়গা, যার বাজারমূল্যে দুই কোটি টাকা। এছাড়া রাজধানী ঢাকায় রয়েছে তার দুটি ফ্ল্যাট।

আছে কোটি কোটি টাকার গাড়ি

প্রতিটি কোটি টাকা মূল্যের দুটি পাজেরো জিপ রয়েছে মো. সেলিমের। দুটি প্রাইভেট কার, ড্রাম ট্রাক রয়েছে অন্তত ২০টি, কনস্ট্রাকশন কাজে ব্যবহৃত ভাড়ায় দেওয়া হয় তার বিশাল যন্ত্রাংশ। যার বাজারমূল্যে প্রায় ১০ কোটি টাকা। এই খাত থেকে বছরে আয় হচ্ছে ন্যূনতম এক কোটি টাকা। দুদক অভিযোগের ফাইলে এসব যন্ত্রাংশের ছবি দেওয়া হয়েছে।

দুদকে দেওয়া অভিযোগে আরও বলা হয়, তথ্য গোপন করে প্রতিবছর নামমাত্র মূল্য নির্ধারণ করে সেলিম তার হাতেগোনা কয়েকটি ব্যবসার আয়কর বিবরণী দাখিল করেন। তার মোট আয়ের অবশিষ্ট পরিমাণ অর্থের পেমেন্ট সার্টিফিকেট দাখিল না করে এসব টাকা অন্যদেশে স্থানান্তর করে মানিলন্ডারিং করছেন সেলিম।

সেলিম সরকারের বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পের কাজ করেছেন যৌথ অংশীদার নিয়ে। এসব প্রকল্পের প্রকৃত আয় গোপন করা হয়েছে তার আয়কর বিবরণীতে। একইসঙ্গে বিভিন্ন পাহাড়ি ঠিকাদার ও অন্যান্য ঠিকাদারের নামে-বেনামে প্রকল্পের কাজ করে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার আয়ের প্রকৃত তথ্য গোপন করে যাচ্ছেন তিনি।

একনজরে ব্যাংক হিসাব

অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন লোকজনের নাম দিয়ে ব্যাংক হিসাব খুলেন মো. সেলিম। তার মধ্যে রয়েছে বীণা ত্রিপুরা ও আসিফ এন্টারপ্রাইজের নামে মার্কেন্টাইল ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ইসলামি ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এবং এসআইবিএল ব্যাংকে হিসাব খুলে অস্বাভাবিক লেনদেন পরিচালনা করে আসছেন সেলিম। এছাড়া তার এসব ব্যাংকে রয়েছে বিপুল পরিমাণের এফডিআর। আয়কর বিবরণীতে দাখিলের সময় এসব অর্থের তথ্য গোপন করেছেন প্রতিবছর।

দুদকে দেওয়া অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর ও আর নিজাম রোড শাখার মার্কেন্টাইল ব্যাংক, খাগড়াছড়ি সদর এলাকায় পূবালী ব্যাংক শাখায় রয়েছে সেলিমের মূল ব্যাংক হিসাব। সেখানে তার শত কোটি টাকার স্থায়ী আমানত রয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে মো. সেলিমকে একাধিকবার মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপে এসএমএস পাঠিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি।

সূত্র: চট্টগ্রাম প্রতিদিন

spot_imgspot_img
spot_imgspot_img

সর্বশেষ