পেঁয়াজের বাজার সিন্ডিকেটের কবলে

 

- Advertisement -

প্রিয় সংবাদ ডেস্ক:: সিন্ডিকেটের কবলে দেশের পেঁয়াজের বাজার। ভারত রোববার পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর রাজধানীসহ সারা দেশে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছে এ সিন্ডিকেট। কেজিতে দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ টাকা। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারসাজি।

তারা সুযোগ বুঝে অতি মুনাফার লোভে একদিনে পেঁয়াজের বাজার বেসামাল করেছে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে পর্যাপ্ত মজুদ আছে। মিয়ানমার, তুরস্ক ও মিসর থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। কেউ অসাধু পন্থায় দাম বাড়ালে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে।

ভারত রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত রাজধানীতে খুচরা পর্যায়ে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকা কেজি। আর আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৮০ টাকায়। তবে রাত ৮টার পর দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ১০০-১১০ টাকা ও ভারতীয় পেঁয়াজ ৯০-১০০ টাকা কেজি।

আর সোমবার রাজধানীর নয়াবাজার, রামপুরা বাজার, শান্তিনগর কাঁচাবাজার ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করতে দেখা গেছে ১২০-১২৫ টাকা কেজি। আমদানি করা পেঁয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১১০-১১৫ টাকায়। রফতানি বন্ধের খবরের পর এক দিনের ব্যবধানে রাজধানীর খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩৫ টাকা।

যুগান্তরের ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা বেড়েছে। এদিকে রাজধানীতে দাম সহনীয় রাখতে টিসিবির ৩৫টি ট্রাক চক্রাকারে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেছে।

আগামী ২ মাস ভালোভাবে চলার মতো পেঁয়াজের মজুদ আছে জানিয়ে বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন সোমবার যুগান্তরকে বলেন, বছরে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ ১৪ হাজার টন। উৎপাদন হয়েছে ২৩ লাখ ৭৪ হাজার টন। এ উৎপাদন থেকে ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। সে হিসাবে সাড়ে ৭ লাখ টন পেঁয়াজের ঘাটতি আছে।

এ সাড়ে ৭ লাখ টন পেঁয়াজ নিয়েই বর্তমানে ঝামেলা তৈরি হয়েছে। কিন্তু চিন্তার কোনো কারণ নেই। মিয়ানমার থেকে দুটি জাহাজে পেঁয়াজ দেশে আসছে। একটি জাহাজ থেকে ইতিমধ্যে পেঁয়াজ খালাস করা হয়েছে। আরও একটি খালাসের অপেক্ষায় আছে। তবে কি পরিমাণ পেঁয়াজ আসছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, তুরস্ক থেকেও পেঁয়াজবাহী জাহাজ বাংলাদেশে আসার পথে আছে। মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন পেঁয়াজ ঢুকছে দেশের বাজারে। আর বর্তমানে দেশে যে পরিমাণে পেঁয়াজ মজুদ আছে, তা দিয়ে আগামী ২ মাস ভালোভাবেই চলবে। এছাড়া দেড় মাস পর দেশি নতুন পেঁয়াজও বাজারে আসবে।

সঙ্গে ভারতের পেঁয়াজও আনা হবে। তাই বলা যায়, কয়েক দিনের মধ্যে পেঁয়াজের দাম সহনীয় হয়ে যাবে। আর এ সময় যদি কেউ বেশি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, একদিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম অনেক বেড়েছে। যা কখনোই কাম্য না। এটা ব্যবসায়ীদের কারসাজি। তাই এ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর এ সময় দেখা যায়- দেশে পেঁয়াজ নিয়ে এক ধরনের নৈরাজ্য তৈরি হয়। তাই সরকারের উচিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করা। যাতে এ সময়ে দেশে পেঁয়াজ নিয়ে কোনো ধরনের নৈরাজ্য তৈরি না হয়।

এদিকে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাজধানীতে খোলাবাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করছে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। এ বিষয়ে টিসিবির মুখপাত্র মো. হুমায়ুন কবির যুগান্তরকে বলেন, পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাজধানীর বিভিন্ন স্পটে পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে। প্রথমে পাঁচটি স্পটে বিক্রি কার্যক্রম শুরু হয়।

পর্যায়ক্রমে তা বাড়িয়ে সোমবার থেকে রাজধানীতে ৩৫টি ট্রাকে চক্রাকারভাবে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হয়। তিনি বলেন, একজন ডিলার ৪৫ টাকা কেজি দরে প্রতিদিন এক হাজার কেজি (এক টন) পেঁয়াজ বিক্রি করবে। যা পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত অব্যহত থাকবে।

বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন সচিবালয়ে সোমবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, দেশি পেঁয়াজ ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ মিলিয়ে মজুদ সন্তোষজনক রয়েছে। মনে করি এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। যারা পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছেন, এর কোনো যুক্তি নেই। যারা মজুদ করবেন এবং বাজারকে অস্থির করার চেষ্টা করবেন তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখানে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।

বাণিজ্য সচিব মজুদ পরিস্থিতি নিয়ে বলেন, দেশে বর্তমানে কতটুকু মজুদ আছে তা জানতে ১০টি টিম পাঠাচ্ছি। যেখান থেকে বেশির ভাগ পেঁয়াজ আসে সেসব এলাকায় যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে এ টিম যাবে। এছাড়া বিভিন্ন স্থলবন্দর যেমন- বেনাপোল, বাংলাবান্ধাসহ বিভিন্ন বন্দরে আমাদের কর্মকর্তারা থাকবেন। তাদের কাজ হবে মনিটরিং করা।

জাফর উদ্দীন বলেন, আমাদের ভ্রাম্যমাণ মোবাইল কোর্ট রয়েছে। ভোক্তা অধিকার, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ চারটি টিম কাজ করছে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যাতে পেঁয়াজ নিয়ে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয়, সেজন্য আমরা কৃষি ও অন্যান্য মন্ত্রণালয় নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা নিচ্ছি। আমাদের ঘাটতি খুব বেশি নয়।

যেহেতু আমরা খাদ্যে স্বয়ঃসম্পূর্ণ হয়েছি কাজেই পেঁয়াজ, রসুন, আদা নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে পদক্ষেপ নিচ্ছি। যাতে ভবিষ্যতে আমদানির দিকে তাকিয়ে থাকতে না হয়। ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করায় একটু সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে বাণিজ্য সচিব বলেন, আমরা বসে নেই। এ বিষয় নিয়ে সোমবার সকালে বসেছিলাম। একটি ভালো খবর হল, মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আনার যে প্রক্রিয়া ছিল সেটার দুটি জাহাজ এসে পৌঁছেছে নৌবন্দরে।

অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি জাহাজের পেঁয়াজ রোববার খালাস হয়েছে। আর একটি জাহাজ খালাস হবে। মিয়ানমার থেকে দুটি চ্যানেলে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। বর্ডার চ্যানেলে একটা চলমান। আর একটা হল ফরমাল চ্যানেলে নৌবন্দর দিয়ে আনা। এছাড়া তুরস্ক ও মিসর থেকে পেঁয়াজ আনার প্রক্রিয়া চলমান।

যুগান্তরের সিলেট ব্যুরো জানায়, ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণার পরপরই দাম বৃদ্ধি ও বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন সিলেটের খোলা বাজারের ব্যবসায়ীরা। রোববার বিকাল ৪টার দিকে এ খবর সিলেটের বাজারে আসে, সে সময় সিলেটের খোলা বাজারে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৬০-৬৫ টাকা। এর আধা ঘণ্টা পর সাড়ে ৪টার দিকে ৯০-১০০ টাকা কেজি বিক্রি শুরু হয়। সন্ধ্যার পর তা বেড়ে ১২০ টাকায় পৌঁছায়। সোমবারও বাজারে ১১০-১২০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হয়।

এদিকে বগুড়া ব্যুরো জানায়, একদিনে প্রতি কেজি পেঁয়াজে ২৫ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। খুচরা ও পাইকারি বাজারে দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রেতাদের সঙ্গে বিক্রেতাদের বাকবিতণ্ডা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত থেকে হঠাৎ আমদানি বন্ধ ও দেশে বন্যার কারণে উৎপাদন কম হওয়ায় পেঁয়াজের দাম বেড়েছে।

সোমবার দুপুরে শহরের বৃহৎ পাইকারি কাঁচামালের বাজার রাজাবাজার ও ফতেহআলী বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- দেশি, ভারতীয় ও বার্মিজ (মিয়ানমার) পেঁয়াজ প্রতি কেজিতে ২৫ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। রাজাবাজারের আড়তদার আল্লাহর দানের মালিক জয়নুল আবেদীন শামীম জানান, রোববার পাইকারি প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৭৫ টাকা ও খুচরা ৮০ থেকে ৯০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এবং ভারতীয় পেঁয়াজ খুচরা ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজি বিক্রি হয়।

সোমবার দেশি পেঁয়াজের দাম পাইকারি ৮৮ থেকে ৯০ টাকা ও খুচরা ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া সোমবার প্রতি কেজি বার্মার পেঁয়াজ পাইকারি ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ও খুচরা ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এ পেঁয়াজ রোববার পাইকারি ও খুচরা বাজারে কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা কম ছিল।

বগুড়া শহরের সুলতানগঞ্জপাড়ার গৃহবধূ আসমা খাতুন বলেন, দু’দিনে প্রতি কেজি পেঁয়াজে ৪০-৫০ টাকা বেড়ে যাওয়ায় আমরা হিমশিম খাচ্ছি। নাটোর প্রতিনিধি জানান, নাটোরে এক লাফে কেজিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৫০ টাকা।

নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চাঁচকৈড়, নাজিরপুর ও ধারাবারিষা বাজারে রোববার যে পেঁয়াজ ৭০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে, রফতানি বন্ধের খবরের পর সোমবার এক লাফে সেই পেঁয়াজ ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

চাঁচকৈড় মোকামের পেঁয়াজ বেপারি উজ্জ্বল শেখ জানান, এক মাসের মধ্যে ৪০ টাকার পেঁয়াজ ৭০-৮০ টাকা হয়। কিন্তু সোমবার সেই পেঁয়াজ ১২০ টাকা কেজি বিক্রি করতে হচ্ছে। এছাড়া মোকামে পাইকারি দরে কিনতে হচ্ছে ১০০ টাকা কেজি।

চুনারুঘাট প্রতিনিধি জানায়, হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের খোলা বাজারে মাত্র এক দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের কেজি ১০০-১২০ টাকা। এতে ক্রেতারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। শহরের বিভিন্ন দোকান ও আড়ত ঘুরে সোমবার দুপুরে দেখা গেছে পেঁয়াজের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে।

বিক্রেতারা পেঁয়াজের কেজি ১২০ টাকা হাঁকছেন। কেন এত দাম জিজ্ঞেস করলে তারা জানান, পেঁয়াজের উৎপাদন কমার ফলে সংকট বেড়েছে। এর মধ্যে ভারত থেকে পেঁয়াজ আসছে না। বেশি দামে কিনেছেন তাই বেশি দামে বিক্রি না করলে পোষাবে না।

মোরেলগঞ্জ প্রতিনিধি জানায়, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। সোমবার দুপুরে সরেজমিন মোরেলগঞ্জ বাজারে কাঁচাবাজার ও পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পেঁয়াজের দাম আকাশছোঁয়া।

রোববার যে পেঁয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৫৫-৭০ টাকা দরে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সেই পেঁয়াজ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা। আর খুচরা বিক্রেতারা বিক্রি করছে ১১০ টাকা কেজি।

সর্বশেষ