প্রিয় সংবাদ ডেস্ক:: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। কাউকে ছাড়া হবে না। কে কোন দল, কী করে না করে, আমি সেটা দেখি না। আমার কাছে অপরাধী অপরাধীই। তিনি বলেন, আমি বাপ-মা, ভাই-বোন সব হারিয়েছি। একটা মেধাবী সন্তান হারানো মায়ের কষ্টটা আমি বুঝি।
বুধবার গণভবনে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান এবং ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে চার পৃষ্ঠার লিখিত বক্তৃতা পড়েন। এরপর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাজধানীসহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক হলে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশনা দেয়া হবে। নামমাত্র টাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কারা পড়াশোনা করছে ও আবাসিক হলে কারা থাকছে, কারা মস্তানি করছে, তা খতিয়ে দেখা হবে। কোনো অনিয়ম সহ্য করা হবে না। তিনি বলেন, সরকারের খরচে হলে বসে জমিদারি চলবে না। আমি কোনো দল-টল দেখব না।
তিনি বলেন, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নেই, বুয়েট চাইলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারে। বুয়েটের কমিটি আছে, তারা যদি মনে করে বন্ধ (ছাত্র রাজনীতি) করে দিতে পারে। এখানে আমরা কোনো হস্তক্ষেপ করব না। এই যে ছেলেটাকে (বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ) হত্যা করল, এটা তো কোনো রাজনীতি না। বসুনিয়াকে রাজনৈতিকভাবে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র রাউফুন বসুনিয়া) হত্যা করা হয়েছিল।
ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছাত্র রাজনীতি ব্যান করে দিতে হবে- এটা তো মিলিটারি ডিক্টেটরদের কথা। এখানে রাজনীতিটা কোথায়? এর কারণটা কোথায়? এটা খুঁজে বের করতে হবে।
তিনি বলেন, দেশের স্বার্থ বিক্রি করবে শেখ হাসিনা সেটা হতে পারে না। ভারতকে ফেনী নদীর পানি দেয়া প্রসঙ্গে বলেন, কেউ পান করার জন্য পানি চাইলে তা না দিলে কেমন দেখায়। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের একটি এলাকায় সামান্য পানি দেয়া হয়েছে। এতে হইচইয়ের কী আছে। ত্রিপুরায় প্রাকৃতিক গ্যাস নয়, এলপিজি রফতানি করা হবে। শুদ্ধি অভিযান প্রসঙ্গে বলেন, যেখানে দুর্নীতির খবর পাওয়া যাবে সেখানেই অভিযান চলবে। দলের আসন্ন সম্মেলনে এ অভিযানের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে ২২ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক সফর করেন শেখ হাসিনা। সেখান থেকে ফিরে ৩ থেকে ৬ অক্টোবর দিল্লি সফর করেন। যুক্তরাষ্ট্র সফরে এবার দুটি সম্মাননা পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাক্সিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই) তাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ সম্মাননায় ভূষিত করেছে।
আর তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ তাকে ভূষিত করেছে ‘চ্যাম্পিয়ন অব স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফর ইয়ুথ’ সম্মাননায়। দিল্লি সফরে প্রধানমন্ত্রী ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম আয়োজিত ইন্ডিয়া ইকোনমিক সামিটে যোগ দেন। শনিবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় এবং তিনটি যৌথ প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়।
এদিকে বুধবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সরকারের মন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। মঞ্চে প্রধানমন্ত্রীর পাশে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
বুয়েট হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ নৃশংসতা কেন? এই জঘন্য কাজ কেন? এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। যত রকমের উচ্চ শাস্তি আছে সেটা দেয়া হবে।’ ঘটনা জানার পর সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগকে ডেকে বলেছি, জড়িতদের যেন বহিষ্কার করা হয়। এখানে আমি ছাত্রলীগ বিবেচনা করব না। যে অন্যায় করেছে, সে অন্যায়কারী। তার বিচার হবে। কারও দাবি-টাবির অপেক্ষায় থাকি না। আমি আগেই নির্দেশ দিয়েছি।
গ্রেফতার হয়েছে। প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বুয়েটের ঘটনা খুব সকালে জানার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে আলামত সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছিলাম। তাদের সিসিটিভির ফুটেজও সংগ্রহ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। তারা দ্রুতই সেখানে পৌঁছে, আলামতের পাশাপাশি সিসিটিভি ফুটেজগুলো দীর্ঘসময় নিয়ে সংগ্রহ করে। তিনি বলেন, যখন পুলিশ সিসি ক্যামেরা থেকে ফুটেজের হার্ডডিস্ক নিয়ে আসছে তখন তাদের ঘেরাও করা হল। ফুটেজ নিয়ে পুলিশকে আসতে দেয়া হবে না। আইজিপি যোগাযোগ করে বলল আমাদের লোকদের আটকে রেখেছে। আলামত নিয়ে আসতে দিচ্ছে না।
প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফুটেজগুলো আনতে দেবে না কেন? তারা বলছে, ফুটেজগুলো পুলিশ নষ্ট করবে। পুলিশ গেছে আলামত সংগ্রহ করতে। তিনি আরও বলেন, ডেডবডির যাতে পোস্টমর্টেম হয়, সে ব্যবস্থা করা হল। ছাত্ররা নামার আগেই কোন রুম, কোথায়, কারা ছিল যে কটাকে হাতে পেয়েছি সবগুলোকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে।
আমার প্রশ্নটা এখানে! পুলিশকে আসতে দেবে না, আলামত নিতে দেবে না। এটা একটু খোঁজ করেন, কেন বাধা দেয়া হল। তিন ঘণ্টা সময় কেন নষ্ট করল? আমি জানি না এর উত্তর আছে কিনা। আন্দোলনই বা কিসের জন্য? বিচার হবেই।
‘বাংলাদেশের স্বার্থ শেখ হাসিনা বিক্রি করবে সেটা হতে পারে না-জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের স্বার্থ আগে দেখি। ভারতের সঙ্গে যে সব সমস্যা ছিল তা ধীরে ধীরে সমাধান করছি। তিনি বলেন, ‘গ্যাস দিয়ে দিচ্ছে’ এটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার বিএনপি। অথচ বিএনপির নেতারাই একসময় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গ্যাস বিক্রি মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। ওই সময় আমরা গ্যাস বিক্রি করতে রাজি হয়নি বলে ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে পারিনি। আমার কথা হচ্ছে, যারা প্রশ্নটা তোলে তারা অতীতটা ভুলে যায় তাড়াতাড়ি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে গ্যাস ত্রিপুরাকে দেয়া হচ্ছে, তা আমদানিকৃত বাল্ক থেকে প্রস্তুতকৃত সিলিন্ডারজাত এলপিজি গ্যাস। এটা আমরা আমদানি করে ভারতে রফতানি করছি। আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানি করছি না। এতে বরং আমরা লাভবান হচ্ছি। আমাদের রফতানির তালিকায় নতুন আরেকটি পণ্য যোগ হল।
ফেনী নদীর থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিপুরা আমাদের অনেক সহায়তা করেছে। এটা ভুলে গেলে চলবে না। তারা আমাদের বাস্তুচ্যুত মানুষকে জায়গা দিয়েছে, খাবার দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়েছে। ত্রিপুরা ছিল আমাদের শক্তিশালী একটি ঘাঁটি। তারা কিছু চাইলে আমাদের দিতে হবে। ফেনী নদী থেকে সামান্য যে পানি প্রত্যাহারের চুক্তি করা হয়েছে, সেটাও খাবার পানির জন্য। এটা নিয়ে এত হৈচৈ করার কী আছে?
সব দায়িত্ব কেন একমাত্র প্রধানমন্ত্রীই নেবেন- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আমি সরকারপ্রধান, ঘুমিয়ে দেশ চালাই না। দেশের মানুষের ভালো-মন্দ সব খেয়াল রাখি। আমি বুঝি না কেন আপনারা এ প্রশ্নটা করেন। কেউ আমাকে দায়িত্ব চাপিয়ে দেয় না, আমি নিজের থেকে সব খবর রাখি। এ দেশ আমার, এ দেশের মানুষ আমার, আমি তাদের ভালোমন্দ নজরদারিতে রাখি। এটা নিয়ে কেন প্রশ্ন আসে তা বোধগম্য নয়।
ক্যাসিনো ও জুয়াড়িদের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হাসতে হাসতে ওদের জন্য একটা দ্বীপ খুঁজে বের করার কথা বলেন। তিনি বলেন, বদ অভ্যাস তো সহজে যাবে না। যারা ক্যাসিনো খেলায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে, তাদের কেউ এখন দেশ থেকে ভেগে যাচ্ছে, টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে। তাই ওদের জন্য সেই দ্বীপে আমরা সব ব্যবস্থা করে দেব।
দরকার হলে ভাসানচর বিশাল দ্বীপ একপাশে রোহিঙ্গা আরেক পাশে ওরা থাকবে। ওরা সেখানেই চলে যাক। লুকিয়ে-চুরিয়ে এগুলো করার চেয়ে কারা চান আমাকে একটা তালিকা দিন, লাইসেন্স নিয়ে-ট্যাক্স দিয়ে পরিচালনা করুন। চলমান শুদ্ধি অভিযান প্রসঙ্গে সরকারপ্রধান বলেন, এই শুদ্ধি অভিযান যতদূর পর্যন্ত প্রয়োজন ততদূর চলবে।