প্রিয় সংবাদ ডেস্ক:: পেঁয়াজের দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না। ভারত থেকে আমদানি বন্ধ ও দেশে ‘সংকট’র অজুহাত দেখিয়ে গত দেড় মাস ধরে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ানো হয়েছে এর দাম। বিশেষ করে গত দু’দিনে এর দাম হুহু করে বেড়ে অস্থির করে তুলেছে রাজধানীসহ সারা দেশের পেঁয়াজের বাজার। রীতিমতো অধিকাংশ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে নিত্যদিনের এ পণ্যটি।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর খুচরা বাজারে যে দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি ২০০-২২০ টাকা বিক্রি হয়েছে, শুক্রবার সেটি ছিল ২৪০-২৫০ টাকা। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে কেজিতে বেড়েছে ৩০-৪০ টাকা। পাশাপাশি পাইকারি বাজারে প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) বিক্রি হয়েছে ১২শ’ টাকা।
এতে প্রতি কেজির দাম পড়ছে ২৪০ টাকা। যা আগের দিন (বৃহস্পতিবার) বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকা। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় বেড়েছে কেজিতে ৬০ টাকা। রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোর চিত্রও প্রায় অভিন্ন।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ভোক্তারা। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন ‘আজ থেকে পেঁয়াজ খাওয়া ছেড়েই দেব’।
পাশাপাশি যেসব সিন্ডিকেট বা অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
যদিও পরিস্থিতি সামাল দিতে কার্গো বিমানে তুরস্ক, মিসর, আফগানিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে জরুরি ভিত্তিতে সরকারি-বেসরকারিভাবে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার
জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ড. গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, প্রতিদিনই পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এতে ভোক্তার ওপর চাপ বাড়ছে। দাম কমাতে সরকারও নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় তদারকি ও অভিযান চালানো হচ্ছে। কিছু বিক্রেতাকে জরিমানাও করা হচ্ছে। তবে সার্বিকভাবে অসাধুদের কারণে সবকিছু ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, যে বা যারা পেঁয়াজের বাজার অনিয়ন্ত্রণ করেছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে অতি অল্প সময়ে পেঁয়াজের দাম ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতায় আনতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
শুক্রবার রাজধানীর নয়াবাজার, শান্তিনগর কাঁচাবাজার, রামপুরা বাজার ও কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশি পেঁয়াজ ছাড়া মিসর থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ২২০-২৩০ টাকা। যা এক দিন আগে বিক্রি হয় ১৬০-১৭০ টাকা। এছাড়া মিয়ানমারের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২০০-২১০ টাকা দরে। যা একদিন আগে বৃহস্পতিবার বিক্রি হয় ১৮০ টাকা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতা মো. ইলিয়াস বলেন, পাইকারি পর্যায়ে পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যে কারণে আমাদেরও বাড়তি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। আর এমন চলতে থাকলে আমরা পণ্যটি বিক্রি বন্ধ করে দেব। কারণ ক্রেতারা পেঁয়াজ কিনতে এসে দাম শুনে আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করছেন।
তিনি আরও বলেন, মোকাম থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা তাদের মনমতো দাম বাড়াচ্ছে। সকালে যে দামে বিক্রি করছে, বিকাল হলে দাম আবার বাড়ানো হচ্ছে। এতে পণ্যটি কিনতে আমাদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে।
একই বাজারে পণ্যটি কিনতে আসা মো. সুমন বলেন, এভাবে দাম বাড়লে কি করে পেঁয়াজ কিনব। এক কেজি পেঁয়াজের দাম ২৫০ টাকা, এটা কোনো কথা হতে পারে না। দেশে কি কোনো আইন নেই? কোনো তদারকি নেই? ব্যবসায়ীরা যা ইচ্ছা তা করছে। সরকারও তা দেখে যাচ্ছে। আর আমাদের মতো সাধারণ ভোক্তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। তাই সরকারের উচিত পেঁয়াজের দাম বাড়ার পেছনের অসাধুদের ধরে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা।
রাজধানীর নয়বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসা মো. ইব্রাহিম বলেন, কাল (বৃহস্পতিবার) পেঁয়াজ কিনলাম প্রতি কেজি ২০০ টাকায়। আর ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ২৫০ টাকা হয়ে গেল? রাতারাতি এভাবে দাম বাড়া কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। আমরা ভোক্তারা আর মানতে পারছি না।
তিনি বলেন, দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পেঁয়াজ খাওয়াও কমিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তারপরও প্রতিদিনই দাম বেড়েই চলছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার ভোলায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ সহায়তা দিতে গিয়ে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, দেশের বাজারে পেঁয়াজ আনতে অনেক আমদানিকারক এলসি খুলেছেন। সে অনুযায়ী পেঁয়াজ দেশে আসার জন্য জাহাজীকরণ করা হয়েছে। যা ৮-১০ দিনের মধ্যে দেশের বাজারে আসবে। তখন পেঁয়াজের দাম কমে যাবে।
এদিন রাজধানীর পেঁয়াজের পাইকারি আড়ত শ্যামবাজার ও কারওয়ান বাজারের আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুক্রবার দেশি পেঁয়াজ প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) ১২শ’ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজির দাম হয় ২৪০ টাকা। যা বৃহস্পতিবার বিক্রি হয় ১৮০ টাকা। মিসরের পেঁয়াজ এক পাল্লা (৫ কেজি) বিক্রি হয়েছে ১১শ’ টাকা। যার এক কেজির পাইকারি দর হয় ২২০ টাকা। তবে বৃহস্পতিবার এ পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকা।
কারওয়ান বাজারের ৪২নং আড়তের ব্যবসায়ী মো. হাকিম বলেন, শ্যামবাজারের আমদানিকারকরা পেঁয়াজের সংকট তৈরি করে রেখেছে। তারা চাহিদার তুলনায় অল্প পরিমাণে পণ্যটি আমাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করছে। তাছাড়া কারওয়ান বাজারের অনেক পাইকারি বিক্রেতা পণ্যটি না পেয়ে খালি হাতে চলে আসছেন। এমন একটা অবস্থা তারা ঘণ্টায় ঘণ্টায় পেঁয়াজের দাম বাড়াচ্ছে। যে কারণে বেশি দামে এনে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
শ্যামবাজারের পেঁয়াজ আমদানিকারক শঙ্কর চন্দ্র ঘোষ যুগান্তরকে বলেন, মোকামে যদি পেঁয়াজ না থাকে থাহলে আমরা কি করে বিক্রি করব। যে হারে চাহিদা আছে কিন্তু তেমন হারে জোগান নেই। যার কারণে দাম বাড়তি। কিন্তু সব দোষ আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ছে। আমরাই বা কি করতে পারি?
তিনি বলেন, সরকার প্রধানের নির্দেশে বড় বড় কোম্পানিগুলো পেঁয়াজ আমদানির জন্য এলসি করেছে। যা আসার জন্য পাইপলাইনে রয়েছে। আর এ চালান দেশের বাজারে এলেই পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমতে থাকবে। আর দেশের উৎপাদিত পেঁয়াজ বাজারে এলেই পেঁয়াজের দাম ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতায় চলে আসবে। এজন্য সবাইকে আরও ১০ থেকে ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হবে।
এদিন পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকি টিম রাজধানীর মিরপুরের শাহআলী থানা এবং পল্লবী থানা এলাকায় পেঁয়াজের পাইকারি ও খুচরা বাজারে অভিযান পরিচালনা করে।
এ সময় পেঁয়াজের মূল্য তালিকা না টানিয়ে মূল্যবৃদ্ধিতে কারসাজি করার অপরাধে আনসার মুদি দোকানকে ২ হাজার টাকা, আইয়ুব মুদি দোকানকে ২ হাজার টাকা, এনামুল হক মুদির দোকানকে ২ হাজার টাকা, সোনার বাংলা ট্রেডার্সকে ৫ হাজার টাকা, এনায়েত ট্রেডার্সকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এ সময় তদারকি কাজে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেন।
অভিযান শেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আবদুল জব্বার মণ্ডল যুগান্তরকে বলেন, দেশে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। বিক্রেতারা কারসাজির মাধ্যমে ‘সংকট’ শব্দটি ছড়িয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে। যার কারণে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অভিযান চালিয়ে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। আর জনস্বার্থে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে। সূত্র:: দৈনিক যুগান্তর