spot_imgspot_img
spot_imgspot_img

খাদ্য সংকট ঠেকাতে উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই

spot_img

মূল্যস্ম্ফীতি, ডলার সংকটসহ দেশের অর্থনীতিতে ৭টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মূলত তৈরি হয়েছে বৈশ্বিক কারণে। তবে দেশে সুশাসনের ঘাটতি ও অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণে তা বেশি প্রকট হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বাংলাদেশসহ ৪৫টি দেশে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা করছে। খাদ্য সংকট মোকাবিলায় উৎপাদন বাড়াতে হবে। পাশাপাশি আমদানি করেও খাদ্যের মজুত বাড়াতে হবে। সরকারকে ব্যয় সাশ্রয়ী হতে হবে। একই সঙ্গে উৎপাদনশীল পদক্ষেপে জোর দিতে হবে।

- Advertisement -

গতকাল গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এমন অভিমত তুলে ধরেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। সিপিডি কার্যালয়ে ‘বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আভাস এবং বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ :উত্তরণ কোন পথে’ শীর্ষক এ ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। এ সময় সংস্থার গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খানসহ কয়েকজন গবেষক উপস্থিত ছিলেন।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, ৭টি সংকট অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সংকট হলো- ডলার, জ্বালানি ও খাদ্য, মূল্যস্ম্ফীতি, রাশিয়ার-ইউক্রেন যুদ্ধ, কভিড-১৯ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা। সংকট উত্তরণে সম্মিলিত পদক্ষেপ দরকার। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের মধ্যে কাজের সমন্বয় দরকার। পাশাপাশি বিভিন্ন অংশীজনকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তথ্যের সঠিকতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক তথ্য ছাড়া সঠিক নীতিমালা করা যায় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য আর্থিক ও মুদ্রানীতির সমন্বয় থাকতে হবে। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। একই সঙ্গে সমস্যা সমাধানে সব পক্ষকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বেড়েছিল। তবে সেপ্টেম্বরে কমেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি কমেছে। প্রবাসী শ্রমিক যাওয়া বেড়েছে, অথচ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমছে। দেশের বাইরে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এমন হচ্ছে বলে ধারণা করা যায়। এ অবস্থায় হুন্ডি প্রবণতা ঠেকানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সংকট সমাধানে স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ নিতে হবে। তবে ঋণ নিয়ে কোনো কারণে যথাযথ ব্যবহার না হলে ঋণই বড় সংকট হয়ে দেখা দেবে।

খাদ্য কেনায় ব্যয় বাড়ন্ত :বর্তমান মূল্যস্ম্ফীতির চাপ বোঝাতে গিয়ে ঢাকায় পারিবারিক খরচের একটি হিসাব দিয়েছে সিপিডি। তাদের জরিপে দেখা গেছে, অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত চার সদস্যের একটি পরিবারে শুধু খাবার কেনায় প্রতি মাসে গড়ে ২২ হাজার ৪২২ টাকা খরচ হয়েছে। খাদ্য তালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিলেও খরচ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৯ টাকা। খাদ্য কেনার ব্যয় বেড়েছে চার বছরে ২৭ থেকে ৩৮ শতাংশ। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্যান্য খরচও অনেক বেড়েছে। ফলে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় খাতে বেতন বাড়ানো এখন অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা মূল্যস্ম্ফীতির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার কম। প্রতি বছর গড়ে ৫ শতাংশ বেতন বাড়লেও মূল্যস্ম্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। সংসার চালাতে নিম্ন আয়ের মানুষ এখন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। বেতন না বাড়ালে আগামীতে অনেকে মাছ-মাংস বাদ দিয়েও সংসারের খরচ মেটাতে পারবে না। অতি দরিদ্রদের জন্য সরকারের ভাতাও বাড়াতে হবে। করোনার সময় ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সুদমুক্ত ঋণ দিতে হবে।
মূল্যস্ম্ফীতির পরিসংখ্যান বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন নয় : ফাহমিদা খাতুন বলেন, মূল্যস্ম্ফীতির যে তথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশ করছে, তাতে প্রকৃত চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না। সরকারি সংস্থা টিসিবির মূল্য তালিকা ধরে হিসাব করলেও দেখা যাচ্ছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দর এক বছরে ২০, ৩০ এমনকি ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, যা ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, ২০০৫ সালের ভোক্তা মূল্য সূচকের ভিত্তিতে মূল্যস্ম্ফীতির হিসাব করা হয়। এ সময়ে ভোক্তা চাহিদায় অনেক পরিবর্তন এলেও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। ফলে ভিত্তি বছর পরিবর্তন দরকার। তার মতে, নিত্যপ্রয়োজনীয় ২৯টি পণ্য আমদানিতে যে কর রয়েছে, তা অনেক বেশি। মূল্যস্ম্ফীতির চাপ কমাতে ধীরে ধীরে কর কমানো উচিত। একই সঙ্গে বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিলিয়ে জ্বালানি তেলের দর কমানোর সুপারিশ করেন তিনি।

খাদ্য সংকট মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি দরকার :ফাহমিদা খাতুন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে আগে থেকেই কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এর মধ্যে যুদ্ধের কারণে উৎপাদন আরও ব্যাহত হচ্ছে। আগামীতে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ৪৫টি দেশে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করছে। এ তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে। খাদ্য সংকট মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, খাদ্য আমদানির জন্য যে পরিমাণ ডলারের প্রয়োজন, আগামীতে থাকবে কিনা দেখতে হবে। আবার বৈশ্বিক খারাপ অবস্থার কারণে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কেউ খাদ্য ছাড়তেও চাইবে না। এ জন্য সংকট মোকাবিলায় উৎপাদন বাড়ানো সবচেয়ে যৌক্তিক সমাধান। এ জন্য সমস্যা সরকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সবার সমস্যা হিসেবে ভাবতে হবে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দিতে হবে :সিপিডি মনে করে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিবেচনায় ৬০ দিনের জ্বালানি মজুত থাকা দরকার। বাংলাদেশে বর্তমানে পেট্রোলিয়াম ও ডিজেল ছাড়া বাকি ক্ষেত্রে মজুত অনেক কম রয়েছে। অনেক এলাকায় এখন ৮ ঘণ্টার বেশি লোডশিডিং হচ্ছে। বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকটের কারণে শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এমন সময়েও গ্যাস উত্তোলনের চেয়ে এলএনজি আমদানিতে বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। পরিস্থিতি উত্তরণে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে নজর বাড়াতে হবে। আর ক্যাপাসিটি চার্জের খরচ কমাতে ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পে’ পদ্ধতিতে যেতে হবে। খনিজ সম্পদ আহরণে জোর দিতে হবে। রপ্তানি খাতে যেন বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকটের প্রভাব না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ফাহমিদা খাতুন বলেন, দীর্ঘ ও মধ্য মেয়াদে সংকট সমাধানের চেয়ে বর্তমানে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত জ্বালানির আমদানি বাড়িয়েছে। পাকিস্তান বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করছে। শ্রীলঙ্কা খরচ কমাতে ১০ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বাসায় থেকে অফিস করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে।

আইএমএফের শর্ত প্রকাশ করা হোক :ফাহমিদা খাতুন বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, তা চিন্তার বিষয়। এক বছরে ১২ বিলিয়ন ডলার কমে রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। এ হিসাবও প্রকৃত নয়। এ সময়ে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার জোর চেষ্টা চলছে, যা ভালো। তবে আইএমএফের ঋণে কোন ধরনের শর্ত থাকবে, তা প্রকাশ করা দরকার। আবার কোনো কারণে ঋণ নিয়ে সঠিক খাতে ব্যবহার করতে না পারলে সংকট বাড়বে। আগামীতে রিজার্ভ যেন আর না কমে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। বিনিময় হার ধরে না রেখে পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।

spot_imgspot_img
spot_imgspot_img

সর্বশেষ