মো.মুক্তার হোসেন বাবু:: বিএনপি-জামায়াত, যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধীরা যাতে আর ক্ষমতায় আসতে না পারে সেজন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহŸান জানান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গতকাল রোববার বিকেল সাড়ে তিনটায় চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক পলোগ্রাউন্ডে চট্টগ্রাম মহানগর এবং উত্তর-দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় তিনি এ আহবান জানান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ভোট পাবে না বলে বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে সরকার উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করতে চায় বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, বিএনপির দুইটা গুণ আছে, ভোট চুরি আর মানুষ খুন; ওইটা পারে। ২০১৩, ১৪, ১৫ সালে বিএনপির আন্দোলনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, অগ্নিসন্ত্রাস করে মানুষ হত্যা, মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করার জবাব একদিন খালেদা জিয়া-তারেক জিয়াকে দিতে হবে, এর হিসেব একদিন জনগণ নেবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ওরা (বিএনপি) জানে ইলেকশন হলে জনগণ তাদের ভোট দেবে না। তাই তারা ইলেকশন চায় না তারা সরকার উৎখাত করে, এমন কিছু আসুক যারা একেবারে নাগরদোলায় করে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে এটাই তারা আশা করে, এটাই তাদের বাস্তবতা। তারা জনগণের তোয়াক্কা করে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি তাদের বলে দিতে চাই, খালেদা জিয়া ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী জনগণের ভোট চুরি করে ক্ষমতায় এসেছিল। আর ভোট চুরি করে ক্ষমতায় এসেছিল বলেই তাকে বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেয়নি। সারা বাংলাদেশ ফুঁসে উঠেছিল। জনতার মঞ্চ করেছিলাম আমরা। খালেদা জিয়া বাধ্য হয়েছিল পদত্যাগ করতে। দেড় মাসও যায়নি, খালেদা জিয়া পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। সে কথা বিএনপির মনে রাখা উচিত। জনগণের ভোট যদি কেউ চুরি করে বাংলাদেশের মানুষ তা মেনে নেয় না। ওরা তা ভুলে গেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ওরা ভোটে যেতে চায় না। জিয়াউর রহমান যেমন জাতির পিতাকে হত্যা করে, সংবিধান লঙ্ঘন করে, সেনা আইন লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করেছিল। ওদের ধারণা ওইভাবেই তারা ক্ষমতায় যাবে। গণতান্ত্রিক ধারা তারা পছন্দ করে না।
সরকার প্রধান বলেন, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, সেই ১০ ডিসেম্বর বিএনপির খুব প্রিয় একটা তারিখ। বোধ হয় পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর পদলেহনের দোসর ছিল বলেই ১০ ডিসেম্বর তারা ঢাকা শহর নাকি দখল করবে। আর আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করবে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, রিজার্ভ এবং ব্যাংকে টাকা নেই বলে গুজব ছড়ানো হচ্ছে অভিযোগ করে শেখ হাসিনা বলেন, একটা গুজব ছড়ানো হচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি আমি, আর সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে অপপ্রচার করছে। অথচ এই কয়েকদিনে যারা টাকা তুলতে গেছে তারা সবাই তো টাকা তুলতে পেরেছে।মানুষকে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহŸান জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে আমার, একটা কথা আছে আপনি ব্যাংকে টাকা রাখবেন, না আপনি খাটের নিচে, বালিশের নিচে না আলমারিতে রাখবেন; চোরেও তো নিয়ে যেতে পারে। গুজবে মানুষ বিভ্রান্ত হয় টাকা তুলে ঘরে আনে, চোরেও নিতে পারে, আবার টাকা নিয়ে ব্যাংকে জমা রাখে। এই যে মানুষকে বিভ্রান্ত করা। বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে চোরের সখ্যতা আছে কিনা এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, এই যে মানুষের সর্বনাশ করা এটাই কি বিএনপি-জামায়াত শিবিরের কাজ। নাকি তাদের সাথে চোরের সখ্যতা আছে, চোরকে চুরি করার সুযোগ করে দেওয়া।
তিনি বলেন, স্বজনহারা বেদনা কি কষ্ট, এটা আমরা যারা ১৫ আগস্ট আপনজন হারিয়েছি আমরা জানি। ১৫ আগস্ট শুধু আমার বাবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেই হত্যা করেনি। একইসঙ্গে আমার মাকে হত্যা করেছে। আমার ভাই মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, তার নব বিবাহিত বধূ সুলতানা তাদেরকে হত্যা করেছে। আমার ভাই মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, তার স্ত্রী ফারবিন জামালকে হত্যা করেছে। আমার ১০ বছরের ছোট ভাই শেখ রাসেল, কি অপরাধ ছিল তার? তাকে হত্যা করেছে। আমার একমাত্র চাচা শেখ আবু নাছের তাকে হত্যা করেছে। সে পঙ্গু ছিল, মুক্তিযোদ্ধা ছিল।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বলেন, আমার পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আমি আর আমার ছোট বোন শেখ রেহেনা বিদেশে ছিলাম। মাত্র ১৫ দিন আগে বিদেশে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভাবতেও পারিনি; হঠাৎ একদিন আমরা এতিম হয়ে যাব। এরপর ছয়টা বছর দেশে আসতে পারিনি। জিয়াউর রহমান সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল, আমাকে দেশে আসতে দেয়নি। রেহেনার পাসপোর্টটা রিনিউ করে দেয়নি। বরং খুনিদেরকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল।
তিনি আরও বলেন, আমি কৃতজ্ঞতা জানাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রতি, বাংলাদেশের জনগণের প্রতি। আর শুকরিয়া আদায় করি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে। ছয় বছর পর আমি বাংলাদেশে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েও অনেক বাধা অতিক্রম করি। যেখানে যুদ্ধ অপরাধীরা ক্ষমতায়, আবার বাবা-মায়ের হত্যাকারীরা ক্ষমতায় আমি সেই দেশের সবকিছু ত্যাগ করে ফিরে এসেছিলাম কেন, এই বাংলাদেশের মানুষের জন্য। যে মানুষের জন্য আমার বাবা সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। আমার মা জীবনে কিচ্ছু চাননি, তার জীবনটাও তিনি ত্যাগ স্বীকার করেছেন এদেশের মানুষের জন্য, স্বাধীনতার জন্য।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আজ বাবা-মা সব হারিয়ে ফিরে এসেছি বাংলার মানুষের জন্য। কেন— এ দেশের মানুষ দু’বেলা পেট ভরে ভাত খাবে, তাদের বাসস্থান হবে, চিকিৎসা হবে, শিক্ষা হবে, উন্নত জীবন পাবে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনকারীদের সেই বিজয়ী জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে চলবো। আমরা যেন সেই ভাবে বাংলাদেশকে গড়তে পারি। আপনাদের দোয়ায় আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বলেন, ১৫ আগস্ট যাদের হারিয়েছি তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া চাই। আপনারা দোয়া করেন সেই সঙ্গে আপনাদের সহযোগিতা চাই— এ বাংলার মাটিতে আবার যেন ওই যুদ্ধাপরাধী, খুনীর দল ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে; তারজন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এ বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে আর ছিনিমিনি খেলতে আমরা দিব না। কারণ, ওই জামায়াত-বিএনপি খুনীর দল, যুদ্ধাপরাধীর দল। জাতির পিতার হত্যাকারীদের মদদদানকারীর দল। আমাকেও বারবার হত্যা করার চেষ্টা করেছে। এরা যেন বাংলাদেশের মানুষের রক্তচুষে খেতে না পারে, আর যেন তারা এ দেশে আসতে না পারে। তাই যাওয়ার আগে মানুষের কাছ থেকে শুধু চাই একটা ওয়াদা— ‘বলেন আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছেন, সেভাবে সুযোগ পেয়েছি। আগামীতে আপনারা ভোট দেবেন নৌকা মার্কায়। হাত তুলে বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, অনেকদিন পর আবার দেখা হলো। ২০১৮ নির্বাচনের আগে এসেছিলাম। আজকে আসার সময় আমি দেখেছি, রাস্তায় অনেকে হয়তো চোখের দেখায় দেখতে পাচ্ছি না। আপনারা যতদূরেই থাকেন, আপনারা আছেন আমার হৃদয়ে-অন্তরে। বাবা-মা, ভাই হারিয়ে আপনাদের কাছেই আমি ফিরে পেতে চাই আমার বাবা-মা, ভাইয়ের ভালোবাসা। আপনারাই আমার পরিবার। আপনাদের কাছেই আমার একমাত্র আশ্রয়। আপনাদের কাছে আসতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। বিদায়ের আগে বলে যেতে চাই— ‘নিঃস্ব আমি রিক্ত আমি দেবার কিছু নেই, আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই।
ভাষণের শুরুতেই তিনি জনসভায় যোগ দেওয়া দলীয় নেতাকর্মী ও সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘অনরা কেএন আছন, গম আছন নি’ (আপনারা কেমন আছেন)।
এর আগে প্রয়াত নেতাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠে শুরু হয় নগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত এই জনসভা। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান দিয়ে সকাল ১০টায় মঞ্চে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এরপর বেলা ১২টায় এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সভার কার্যক্রম। ১২টা থেকেই চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের সঞ্চালনায় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দীন চৌধুরীর সভাপতিত্বে চট্টগ্রামের স্থানীয় এমপি, কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় জনসভার আনুষ্ঠানিকতা। শুরুতে স্থানীয় নেতারা বক্তব্য রাখেন। সঞ্চালনায় করেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদ ও নগর সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। বক্তব্য রাখেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আ’লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এম.পি, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এম.পিসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
১৬০ ফুট দৈর্ঘ্যরে মঞ্চটি তৈরি করা হয়েছে নৌকার আদলে। সেখান অন্তত ২০০ জন বসতে পারবেন। মঞ্চের সামনে বড় গোল আকৃতির বোর্ডে লেখা ‘নৌকায় ভোট দিন’। প্রধানমন্ত্রী সভাস্থলে যান বেলা ৩টায়। তবে জনসভাস্থল অনেকটা পূর্ণ হয়ে যায় দুপুর গড়ানোর আগেই। চট্টগ্রাম নগরীর সব প্রবেশ পথ দিয়ে বিভিন্ন যানবাহানে করে উপজেলাগুলো থেকে আসা হাজার হাজার নেতাকর্মী মাঠের দিকে আসতে শুরু করেন সকাল থেকেই। শনিবার রাতেও অনেকে নগরীতে এসে পৌঁছান।
দূরবর্তী উপজেলাগুলো থেকে আসা নেতাকর্মীরা শনিবার রাতে নগরীর বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারে এসে অবস্থান নেন। নেতাকর্মীদের মাঝে শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার সকালে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয় বিভিন্ন নেতার পক্ষে।
জনতার ¯্রােত ছিল বিআরটিসির মোড়, সিআরবি, টাইগার পাস এলাকা পর্যন্ত। নেতাকর্মী ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ এবং শেখ হাসিনার নামে স্লোগান দিতে দিতে জনসভার মাঠে প্রবেশ করছিল। ফুল আর পতাকায় সাজানো একটি নৌকাও দেখা যায় সভাস্থলের পথে। ভাটিয়ারিতে বাংলাদেশ মিলেটারি একাডেমিতে রাষ্ট্রপতি কুচকাওয়াজের অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ শেষে তিনি হেলিকপ্টারে করে এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে নামেন। সেখান থেকে সিআরবি হয়ে পলোগ্রাউন্ডে মাঠে আসেন।
এর আগে ২০১৮ সালের ২১ মার্চ পটিয়া উপজেলায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে চট্টগ্রামে ২০১২ সালের ২৮ মার্চ ১৪ দলের জনসভার পর নগরীতে প্রধানমন্ত্রীর আর কোনো সমাবেশ হয়নি।