তিন সিটিতে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই মন্তব্য করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, নির্বাচন ঘিরে তিন সিটির ভোটারদের মাঝে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। জনগণ প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে পারছেনা।
আজ শনিবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের সমালোচনা করে সরকার প্রধানের উদ্দেশ বলেন, আপনি ক্ষমতা দখল করে দখলদার প্রধানমন্ত্রী হয়ে জনগণের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। আপনার ক্ষমতার উৎস জনগণ নয়, আপনার ক্ষমতার উৎস অন্য কোথাও।
রাজধানীর নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রীর পাহাড়ী নদীর মতো কথা বলার স্রোত। তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দিনমান অনর্গল সমালোচনা করতে তিনি অক্লান্ত। তাই তো অবৈধ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ‘খালেদার মুক্তির জন্য কিছুই করতে পারবো না।’
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, আপনি তো পারবেন না এজন্যই যে, পথের কাঁটা নিষ্কন্টক করতেই তো তাকে কারাবন্দী করেছেন। আপনি নির্বাক, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষহীন বাংলাদেশ চাচ্ছেন, আপনি চিরদিন ক্ষমতায় থাকতে চাচ্ছেন। সেজন্য আপনার প্রয়োজন একতরফা নির্বাচন, আর এই নির্বাচনের প্রধান প্রতিবন্ধকতা দেশনেত্রী বেগম জিয়া।
রিজভী বলেন, ১/১১ এর সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পাঁচটি মিথ্যা মামলা দিয়েছে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে। আর আপনার বিরুদ্ধে দিয়েছিল পনেরটি। আপনার বক্তব্য অনুযায়ী বেগম খালেদা জিয়ার মামলা যদি সত্য হয়, তাহলে আপনারটা মিথ্যা হবে কেনো? আপনার সব মামলা মিলিয়ে তো আপনার একশো বছরের বেশী জেল হবার কথা। কিন্তু এত অনাচার, রক্তপাত, মানুষ খুন, ক্রসফায়ারে নির্বিচারে হত্যা, বিএনপির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাসহ দেশের নানা শ্রেণী-পেশাসহ মুক্ত চিন্তার মানুষরা গুম হয়েছে আপনার সরকারের দ্বারা, আর সেই সরকারের প্রধান আপনি।
তিনি বলেন, আপনি ভোটারবিহীন প্রধানমন্ত্রী হয়ে দিব্যি বহাল তবিয়তে আপনার বিরোধীদের পিন্ডি চটকাচ্ছেন। অথচ আপনি কারাগারে নেই, আপনি ক্ষমতা দখল করে দখলদার প্রধানমন্ত্রী হয়ে জনগণের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। নিজের ক্ষমতার চাহিদা মেটাতে আপনি জনগণকে পরাধীনতার সুদৃঢ় বন্ধনে বন্দী করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে রিজভী বলেন, আপনি গণদাবিকে সুনজরে দেখেন না বলেই জনগণের অধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী দেশনেত্রীকে বন্দী করেছেন। এই বন্দীশালা আপনার হুকুমে পরিচালিত হয়, কোনো আইনের দ্বারা পরিচালিত হয় না বলেই বেগম খালেদা জিয়া সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না, কারাবিধি অনুযায়ী স্বজনরা তার সাথে সপ্তাহে একদিন দেখাও করতে পারছেন না। কারাগারে দেশনেত্রীর ওপর জুলুমের তীব্রতার মাত্রা নিশ্চিত করতে আপনি সবসময় খবর নিচ্ছেন।
রিজভী বলেন, অবৈধ সরকারের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রযন্ত্রকে কব্জায় নিয়ে নিজের মতো করে গণতন্ত্রের সজ্ঞা দিয়েছেন। চিরন্তণ বহুদলীয় গণতন্ত্রকে মৃত্যু শয্যায় পাঠিয়ে সম্রাজ্ঞীর ক্ষমতা হাতে নিয়েছেন। তাই নিজের স্বার্থের জন্য দেশের জনপদের পর জনপদে রক্তস্রোত বইয়ে দিতে কোনো দ্বিধাই করছেন না। মানববাদী জীবনাদর্শের জাগরণকে অবৈধ প্রধানমন্ত্রী বিষাক্ত প্রতিহিংসায় স্তব্ধ করে দিতে চাচ্ছেন। অনন্ত ক্ষমতা ভোগের লালসার জন্য জনগণকে ত্যাজ্য করে হুমকি, হত্যা, সন্ত্রাস ও চোখ রাঙানীতেই ভরসা করছে ভোটারবিহীন আওয়ামী সরকার।
তিনি আরো বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া একজনের ক্রুদ্ধ প্রতিহিংসার শিকার। ভুয়া নথির ওপর ভিত্তি করে সাজানো মামলাতে বেগম জিয়ার বিন্দুমাত্র কোনো সম্পর্ক নেই। শেখ হাসিনার নির্দেশেই বেগম জিয়া কারাগারে। এই বন্দীশালার চাবি রয়েছে শেখ হাসিনার হাতে, অন্য কোথাও নয়।
রিজভী বলেন, আগামী তিন সিটি নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন মহল একটা ধুলিঝড়ের সৃষ্টি করে মূলত: খারাপ কোনো চক্রান্তে মেতে আছে। আসলে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী সাধারণ ভোটারদের অধিকার ফিরে পাওয়াকে অপরাধ হিসেবে গন্য করে, সেজন্য তারা ভোট সন্ত্রাস ও ভোট কারচুপির নতুন নতুন মডেল আবিস্কার করে যাচ্ছে। তিন সিটিতে নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর থেকেই নৌকা মার্কার প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অসংখ্য অভিযোগ আসতে থাকে।
রিজভী অভিযোগ করেন, বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট প্রার্থী এবং সমর্থক ও কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান এক চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। খুলনা-গাজীপুর নির্বাচনের মতোই আসন্ন তিন সিটি নির্বাচনে বিরোধী দলের ভোটার ও পোলিং এজেন্ট শুন্য করার এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করেছে।
তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশে তিন সিটি কর্পোরেশনে একপেশে নির্বাচন করার ডিজাইনারের কাজ করে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ প্রশাসন। নির্বাচন কমিশন যে সরকারের হাতের মুঠোয় সেই প্রমান নিজেরাই রেখে যাচ্ছে, যেমন তিন সিটিতে তফশীল ঘোষনার পর বিনা ওয়ারেন্টে কাউকে গ্রেফতার না করার প্রজ্ঞাপন জারির উদ্যোগ নিয়েছিল ইসি। কিন্তু পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের আপত্তির মুখে সেই উদ্যোগ থেকে সরে আসে কমিশন।
বিএনপির শীর্ষ এই নেতা বলেন, প্রচারণা শুরুর পর থেকেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে আগ্রাসী আক্রমণ চালাচ্ছে। বিরোধী নেতাকর্মী ও সমর্থকদের তালিকা ধরে গ্রেফতার অব্যাহত আছে।
রিজভী বলেন, অবিরাম পুলিশী হয়রানীতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের অসহায় পরিবার। তাদের নামে মামলা না থাকলেও পেন্ডিং মামলায় তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। গ্রেফতারের পর পুলিশ বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের অবস্থানও জানায় না। আর নিবাচন নিয়ে এতো অনাচারের পরেও নীরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছে নির্বাচন কমিশন।
সংবাদ সম্মেলনে রিজভী অবিযোগ করেন, বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এলাকায় গতকাল সারারাত বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ হানা দিয়েছে। বাসায় গিয়ে তারা পরিবারের সদস্যদের বলেছে ২ আগষ্টের আগে কাউকে যেন সিটি কর্পোরেশন এলাকায় দেখা না যায়।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে গ্রেফতার না করার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশ থাকলেও সেটিকে অমান্য করে পুলিশ লাগাতার গ্রেফতার করছে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের। ধানের শীষের প্রার্থীর উঠোন বৈঠক ও সভাও ভেঙ্গে দিচ্ছে পুলিশ। গত পরশু রাত থেকে বিএনপি নেতা জুলহাস উদ্দিন মাসুদ, আব্দুল মান্নান, নাসির আহমেদ, শ্রমিক দল নেতা নুরু মিয়া ও ৩০ নং ওয়ার্ডের ছাত্রদল যুবদল সভাপতিসহ প্রায় ৩০ জনের মতো নেতাকর্মীদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এলাকায় গণগ্রেফতারের গতি থামছেই না। সেখানে নির্বাচনে নৌকা মার্কার পক্ষে ভোট কারচুপির মহা আয়োজনের আভাস স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রায় ৯০ শতাংশ আওয়ামী সমর্থিত লোকদের পোলিং ও প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ভোটের আগের রাতে নৌকায় সিল মারা ব্যালট পেপার ভোটকেন্দ্রে লুকিয়ে রাখা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ধানের শীষের প্রার্থী।
রিজভী বলেন, ভোটের আগের দিন প্রিজাইডিং অফিসারদের দিয়ে ভোট কেটে সেটি লুকিয়ে রাখা হবে হেড মাস্টার অথবা এ্যাসিসটেন্ট হেড মাস্টারের রুমে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। নৌকা মার্কার প্রার্থী জোর করে বিজয়ী হওয়ার জন্য হাজার হাজার লোককে সিটি এলাকায় ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাজশাহীর বিভিন্ন আবাসিক হোটেল ও অন্যান্য আবাসস্থল দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন এলাকার আওয়ামী লীগের লোকেরা।
রিজভী জানান, সিলেট সিটি নির্বাচনেও রাজশাহী ও বরিশালের মতোই চিত্র। নির্বাচনী এলাকায় ভোটারদের মধ্যে কোনো আনন্দ উচ্ছাস নেই, ভোটারদের মনে একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছে। পরশু রাতেও বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ হানা দিয়েছে, গ্রেফতারও করেছে কয়েকজনকে। আর ইতোমধ্যে মামলা দিয়ে কয়েকশ নেতাকর্মীকে ঘরছাড়া করা হয়েছে।
সিলেটেও নেতাকর্মীদের গ্রেফতার বা হয়রানী না করার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশ থাকলেও পুলিশ সেটি অমান্য করে ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন রিজভী।
বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, জনগণ প্রশাসন ও ইসির ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। যদি সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকে তাহলে বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো ভোটাররা ধানের শীষে ভোট দেবে। আমি দলের পক্ষ থেকে তিন সিটিতে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও তাদেরকে হেনস্তা করার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে যেসব নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও নি:শর্ত মুক্তির জোর দাবি করছি। নয়াদিগন্ত