ডেস্ক রিপোর্ট: দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এবারো জাতীয় পার্টিকে নিয়ে চরম আস্থা সঙ্কটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সম্প্রতি জাপার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদের পৃথকভাবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎকে দলের ভেতর আবারো এরশাদ-রওশনের দ্বন্দ্ব হিসেবেই মনে করছেন দলের নেতাকর্মীরা।
জাপার সিনিয়র নেতাদের মতে, গত নির্বাচনের মতো এবারো এরশাদকে নিয়ে মহাজোটগতভাবে নির্বাচন করার বিষয়ে আওয়ামী লীগে শঙ্কা কাটেনি। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটগতভাবে নির্বাচন হলে কার কাছে থাকবে জাপার কর্তৃত্ব-তা নিয়েই মূলত এই শঙ্কা। নেতৃত্বে এরশাদ না রওশন, তা নিয়ে দলের ভেতর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এখনো কাটেনি। কারণ দলের ভেতরের একটি অংশ এখনো প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাথে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। এমন অভিযোগও রয়েছে। এসব বিষয়ে জাপার নানামুখী তৎপরতায় ক্ষমতাসীন দলেও এরশাদের ব্যাপারে অবিশ্বাস-সন্দেহ দূর হয়নি।
কারণ হিসেবে দলের একাধিক নেতা জানান, গতবার এরশাদের হাতে ক্ষমতা থাকায় এরশাদ হঠাৎ করে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়ে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়ার বিষয়টি সরকারের মাথায় রয়েছে। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতীয় পার্টির নেতাদের নানামুখী তৎপরতা ও কর্মকাণ্ড মাথায় রেখেই এগোতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। গতবার তাই নির্বাচনের ঠিক আগে মুহূর্তে নিরুপায় হয়ে আওয়ামী লীগকে বেছে নিতে হয়েছিল ওই সময়ের বিএনপিপন্থী বেগম রওশন এরশাদ ও তার সমর্থিত নেতাদের। এবারো তাই এরশাদকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না ক্ষমসতাসীনরা। এরশাদ ও রওশনের মাঝে দূরত্বের কথা স্বীকার করে জাপার এক প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, দলের মধ্যে বিদ্যমান গ্রুপিংয়ের কারণে সরকারের কাছে সেভাবে আস্থায় আসতে পারছে না জাপা।
এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গণমাধ্যমকে বলেছেন, এরশাদ সাহেব ও বেগম রওশনের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য আছে- তবে তা অবশ্যই আগামীতে কমে আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
গত ১০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে বসেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এসময় তার সাথে দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলু এমপি এবং কাজী ফিরোজ রশিদ এমপি উপস্থিত থাকলেও বৈঠকের বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না বিরোধী দলের নেতা এবং দলের সিনিয়র কো- চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ। প্রধানমন্ত্রীও বৈঠকে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদকে না দেখে এর কারণ জানতে চান। বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে এরশাদ নির্বাচনকালীন সরকারে তার দলের থাকার আগ্রহ ব্যক্ত করেন। ওই মন্ত্রিসভায় তিনি তার পছন্দের তিনজনের নামও প্রস্তাব করেন। রওশনকে বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে এরশাদের ওই বৈঠকে জাপাকে নিয়ে আস্থাসঙ্কটের বিষয়টি আলোচনায় আসে। বৈঠকে জাপার এক প্রভাবশালী নেতাকে বিএনপির সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়েও অভিযুক্ত করা হয় বলে জানা গেছে।
এ দিকে বৈঠক সম্পর্কে না জানানোর কারণে এরশাদ এবং দলের মহাসচিবের কাছে জবাব চেয়েছেন রওশন এরশাদ। বিরোধী দলের নেত্রীকে না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন জাপার একাধিক এমপি। পরে অবশ্য রওশনকে ডেকে নিয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
এ বিষয়ে ফখরুল ইমাম এমপি বলেন, এরশাদ আমাদের নেত্রী রওশন এরশাদকে না নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। পরে প্রধানমন্ত্রী ১৯ সেপ্টেম্বর আমাদের নেত্রী রওশন এরশাদকে ডেকে সাক্ষাৎ দেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রওশন এরশাদ একান্তে বৈঠক করেন। বৈঠকে আগামী নির্বাচনে জাপার আসনসংখ্যা, নির্বাচনকালীন মন্ত্রী এবং জাপার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতে দলের চেয়ারম্যান এরশাদ নির্বাচনকালীন সরকারে জাপার মহাসচিবসহ কাজী ফিরোজ রশিদ ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর নাম প্রস্তাব করলেও রওশন এরশাদ তাতে দ্বিমত পোষণ করে ফখরুল ইমামসহ কয়েকজনের নাম প্রস্তাব করেন। একই সাথে তিনি বিরোধী দলের চিপ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরীর মৃত্যুতে পদটি শূন্য হওয়ায় ওই পদে নুরুল ইসলাম ওমর এমপির নাম প্রস্তাব করলে প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে তা কার্যকরের ব্যবস্থা নেন। এর ফলে নুরুল ইসলাম ওমর বর্তমানে চিফ হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
জাতীয় পার্টির ওপর সরকারের আস্থাহীনতা ও সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সাথে জাপার শীর্ষ দুই নেতার পৃথক বৈঠক প্রসঙ্গে জাপার কো-চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী জি এম কাদের বলেন, এটি অস্বাভাবিক নয়- তবে নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী বানানোর জন্য দুইজন আলাদা তালিকা দিলে সেটি অবশ্যই ভাবার বিষয়।
গত ১৮ এবং ১৯ সেপ্টেম্বর বসুন্ধরা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটিতে অনুষ্ঠিত জাপার ডিজিটাল নির্বাচনী প্রচারণার কর্মশালায় রওশন এরশাদসহ দলের বেশির ভাগ এমপি ও প্রেসিডিয়াম সদস্য উপস্থিত না থাকায় এরশাদ ও রওশনের মধ্যে দূরত্ব দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রওশনপন্থীদের অভিযোগ, দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার নিজেই এরশাদ ও রওশনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে ভূমিকা রাখছেন। এ পরিস্থিতিতে অনেকটা বিপাকে পড়েছেন দলের সংসদ সদস্যরা। আগামীতে কার নেতৃত্বে আসন নির্ধারণ হবে তা নিয়ে কেউ নিশ্চিত নন। তাই তারা দুই কুলই রক্ষা করে চলছেন।