জামায়াতে অস্থিরতা চরমে

 

- Advertisement -

সংস্কার ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামীতে অস্থিরতা চরমে। দীর্ঘদিন ধরেই বিরাজ করছে এ অস্থিরতা। শুক্রবার দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগ করার মধ্য দিয়ে তা প্রকাশ্য রূপ নেয়।

পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে খোদ দলটির আমীর মকবুল আহমদই আর স্বপদে থাকতে চাইছেন না। একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া ও দল বিলুপ্তি ইস্যুতে সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে তারও মতবিরোধ চলছে। শনিবার জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য মজিবুর রহমান মঞ্জুকে বহিষ্কার করার ঘটনায় দলের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা আরও ফুটে ওঠে। একইদিন জামায়াতের দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার এক নেতা মো. বখতিয়ার উদ্দিন স্বেচ্ছায় দল থেকে পদত্যাগ করেন। সংস্কার ইস্যুতে শিগগিরই দলের অনেকেই পদত্যাগ করতে পারেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।

আরও জানা গেছে, পরিস্থিতি মোকাবেলায় দলের অবস্থান জানিয়ে শুক্রবার তৃণমূলকে চিঠি দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। চিঠিতে বলা হয়, সংগঠনের সব সিদ্ধান্ত দলের আমীর, সেক্রেটারি, অঞ্চল দায়িত্বশীল, জেলা ও মহানগর আমীরের মাধ্যমে যথাসময়ে সরাসরি জানানো হবে। এর বাইরে কারও আবেদন-নিবেদন ও অনুরোধে নেতাকর্মীরা যাতে সাড়া না দেয়, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে জামায়াতের আমীর মকবুল আহমদ ও সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে দল থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরা সদস্য মজিবুর রহমান মঞ্জু শনিবার তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, জামায়াতে রাজনৈতিক সংস্কারের যৌক্তিকতা, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ভূমিকা প্রসঙ্গে আমার সুস্পষ্ট মত ছিল যে, জামায়াতে প্রয়োজনীয় সংস্কার না হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমার এরূপ খোলামেলা মত নিয়ে জামায়াতের সম্মানিত নেতাদের মধ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।

সংস্কার ইস্যুতে দলে বিভক্তি প্রকাশ্য হওয়ায় বিব্রত জামায়াতে ইসলামীর আমীর মকবুল আহমদ। তার একজন ঘনিষ্ঠজন (নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক) যুগান্তরকে জানান, বিব্রত হওয়ার বিষয়টি দলের আমীর আমাদের কয়েকজনকে জানিয়ে বলেছেন, তার বয়স হয়েছে। এই বয়সে এসে দলের মধ্যে এমন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে তা তিনি আসা করেননি। তাই আমীর পদে তিনি আর থাকতে চাইছেন না। তিনি জামায়াতের সদস্য পদে থাকতেই স্বস্তিবোধ করছেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং নতুন নামে দল গঠন নিয়েই মূলত জামায়াতে মতভেদ দেখা দিয়েছে। ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক শুক্রবার পদত্যাগপত্রে দাবি করেছেন, স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইতে তিনি জামায়াতকে একাধিকবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে তার সেই পরামর্শ উপেক্ষা করা হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াতের নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানও প্রায় ৯ বছর আগে কারাগার থেকে লেখা এক চিঠিতে দলে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছিলেন।

দীর্ঘ ওই চিঠিতে বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে কামারুজ্জামান লিখেছিলেন, প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ কী? এ ব্যপারে কয়েক দফা পরামর্শও দেন তিনি। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ১) যা হবার হবে। আমরা যেমন আছি তেমনি থাকব (বতমানে এই কৌশলই অবলম্বন করা হয়েছে)। ২) পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে পেছন থেকে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তুলবে। এই সংগঠন প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার সঙ্গে ধর্মহীন শক্তির মোকাবেলা করবে। ৩) আমাদের যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে তারা জামায়াতের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াব এবং সম্পূর্ণ নতুন লোকদের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেব।

পরবর্তী সময়ে মতিউর রহমান নিজামীর স্ত্রী শামসুন্নাহার নিজামী ‘বিবেচনায় আনতে হবে সবকিছু’ শিরোনামে একটি লেখায় কামারুজ্জামানের পরামর্শগুলোর বিরোধিতা করেন। সংস্কার ইস্যু নিয়ে জামায়াতে তখন বিতর্ক শুরু হলে ‘ইসলামী আন্দোলনে হীনম্মন্যতাবোধের সুযোগ নেই’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় জামায়াত সমর্থিত একটি জাতীয় দৈনিকে। ধারণা করা হয়, আবু নকীব ছদ্মনামে কারাগার থেকে লেখাটি লিখেছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। প্রবন্ধটি প্রকাশের পর এ ইস্যুতে প্রকাশ্যে আর কথা বলার সাহস দেখায়নি কোনো নেতা।

জামায়াতের একাধিক সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া ও নতুন দল গঠনসহ আরও কয়েকটি ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরেই সোচ্চার শিবির থেকে আসা জামায়াতের তরুণ নেতারা। তাদের বেশির ভাগই আবার সদ্য পদত্যাগকারী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের অনুসারী বলে পরিচিত। তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করে জামায়াতে সংস্কার ইস্যুতে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করছেন একজন বুদ্ধিজীবীও (তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড থেকে নিষ্ক্রিয় আছেন)।

সম্প্রতি ওই বুদ্ধিজীবী মালয়েশিয়ায় জামায়াত নেতাদের (যারা সংস্কার চান) নিয়ে বৈঠকও করেছেন। সেখানে মালয়েশিয়া ও ইউরোপে থাকা বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাও উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে একটি মাত্র ইস্যুই ছিল নতুন দল গঠন। তবে এ নিয়ে জামায়াতের আমীর ও সেক্রেটারি জেনারেল- এ দু’জনের মধ্যেও মতবিরোধ দেখা দেয়। দলের আমীর মকবুল আহমদ সদ্য পদত্যাগ করা আবদুর রাজ্জাকের যুক্তির সঙ্গে একমত ছিলেন। তবে সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এর বিপক্ষে।

দলের কর্মপরিষদের এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, সেক্রেটারি জেনারেলের যুক্তি হচ্ছে একাত্তরে ভূমিকার জন্য জামায়াত যদি আজ ক্ষমা চায়, পরদিন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলবেন কেন ক্ষমা চেয়েছে? এর পেছনে উদ্দেশ্য আছে কিনা খোঁজা শুরু করবেন। আর নতুন নামে দল গঠন নিয়ে তার মত- এটি করা করা হলেও দলীয় নেতাকর্মীরা মামলা-হামলা-নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবে না। তবে সেক্রেটারি জেনারেল এ-ও মনে করেন, দলের সব নেতা এসব বিষয়ে একমত পোষণ করলে তাতে তার কোনো আপত্তি নেই।

সর্বশেষ দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জরুরি সভায় তরুণ নেতৃত্বের দাবির মুখে একাত্তরের ভুল রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং জামায়াত নামক দল বিলুপ্ত করে সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে দলকে নিয়োজিত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। যা পরে দলের কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরায় অনুমোদন পায়নি। জামায়াতের একটি সূত্র জানায়, নতুন নামে দল গঠনের প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে জামায়াতে ইসলামীতে। নতুন নামে দল গঠনের প্রস্তাব আসে জামায়াতের মজলিশে শূরা থেকেই। প্রস্তাব বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে দলের নির্বাহী পরিষদকে। চলতি বছরেই নতুন দল গঠিত হতে পারে। তবে দলের নাম চূড়ান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত হয়েছে, নতুন দল ধর্মভিত্তিক হবে না। নতুন দল গঠিত হলেও বিলুপ্ত হবে না নিবন্ধন হারানো জামায়াত। যেটি থাকবে ‘আদর্শিক সংগঠন’ হিসেবে, কিন্তু ভোটে থাকবে না। ভোটের রাজনীতিতে থাকবে নতুন দল।

এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী বলেন, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক যদি পদত্যাগ করে মুখ না খুলতেন, তাহলে আমরা বুঝতে পারতাম না যে, জামায়াতে সংস্কার প্রক্রিয়া কতদিন ধরে চলছে। ব্যারিস্টার রাজ্জাক জানিয়েছেন, তিনি ৩০ বছর ধরে চেষ্টা করছেন জামায়াতের ভেতরে একটা সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করার জন্য। ধরেন এখন যাদের বয়স ৬০ থেকে ৬৫ বছর, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের বয়স ছিল ১২-১৩ বছর। জামায়াতে যারা তরুণ জেনারেশন তাদের কারোরই বয়স ৫০-এর ওপরে নয়। তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেইনি। কিন্তু তারা কেন দায়ভার বহন করবে।

জানা গেছে, জামায়াতের বেশির ভাগ নেতাই মনে করেন- মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা নিয়ে আজও তাড়া করছে দলটিকে। এটিসহ আরও কয়েকটি ইস্যুতে জামায়াতে তৈরি হয়েছে বড় ধরনের অস্থিরতা। এর সর্বশেষ সংযোজন হিসেবেই দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক পদত্যাগ করেছেন। এই ইস্যুগুলো শিগগিরই সুরাহা করতে না পারলে অনেকেই পদত্যাগ করতে পারেন।

তৃণমূলে জামায়াতের চিঠি : দলের সহকারী সেক্রেটারি ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও শিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জুকে নিয়ে সারা দেশে দৃষ্টি আকর্ষণী মর্মে শুক্রবার একটি চিঠি পাঠিয়েছে জামায়াত। সেখানে দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগে আমরা মর্মাহত। সংগঠনের এক কঠিন সময় এটা আমাদের বাড়তি কষ্টের কারণ। দীর্ঘদিন তিনি আমাদের সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন।

বিশেষ করে আইন অঙ্গনে সংগঠনের কঠিন সময়ে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তার অতীতের সব অবদানকে সম্মানের চোখে দেখি। ব্যারিস্টার রাজ্জাকের ব্যাপারে আমাদের সব কর্মীর প্রতি অনুরোধ, তার ব্যাপারে কেউ কোনো বিরূপ মন্তব্য করবেন না। তার পদত্যাগের প্রসঙ্গ টেনে দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, উনার পদত্যাগের বিষয়ে অবহিত করলে আমরা তাকে আন্তরিক অনুরোধ করেছিলাম পদত্যাগ না করার জন্য। তিনি তাতে সম্মত হননি। তিনি গণমাধ্যমে তার এ পদত্যাগের ব্যাপারে অবহিত করবেন বলে আমাদের জানালে, আমরা বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলাম মিডিয়ায় না দেয়ার জন্য। দুঃখজনক হলেও সত্য, তিনি আমাদের অনুরোধটিও রক্ষা করেননি।

এরপর শিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জুর ব্যাপারে ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বিগত কয়েক বছর থেকে তিনি সংগঠনের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশ্যে ভিন্নমত প্রকাশ করে আসছিলেন, যা সংগঠনের জন্য খুবই বিব্রতকর। গোড়ার দিকেই ঢাকা মহানগর ও কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলরা একাধিকবার তার সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলেন এবং তার সব কর্মকাণ্ড সংগঠনের শৃঙ্খলা পরিপন্থী হওয়ায় তাকে এসব পরিহার করার জন্য সতর্ক করা হয়।

এমনকি সে সময়ে তিনি একটি ভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করেন। এ বিষয়ে দলের আমীরের নেতৃত্বে ও মহানগরীর নেতারা বসে এ রকম কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার জন্য তাকে সিদ্ধান্ত দেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার প্রতি এ দরদ ও উদারতার কোনো মূল্যই তিনি দেননি। সম্প্রতি তিনি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সফর করে জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ে লোকদের নিয়ে বিভিন্ন বৈঠক করেন, যা সংগঠনের সিদ্ধান্তের বাইরে। তিনি নিজ দায়িত্বে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তোলার বিষয়ে এসব বৈঠকে আলোচনা করেন, যা সংগঠনের রীতিনীতি ও নিয়ম-শৃঙ্খলার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
যদিও তার এ উদ্যোগে সংগঠনের কঠিন দিনের সহকর্মীরা তেমন সাড়া দেননি। তারপরও একজন লোক এ সংগঠন থেকে দূরে চলে যাক সংগঠন তা চায় না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঢাকা মহানগরীর উত্তর শাখা তার সঙ্গে কথা বলে। এ ক্ষেত্রে তার বক্তব্য সন্তোষজনক ছিল না। এমনকি তার এরূপ কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে মোটেই অনুতপ্ত মনে হয়নি। তাকে দেয়া সংশোধনের সুযোগ তিনি কাজে লাগাতে পারেননি এবং বর্তমানেও অনুরূপ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ায় তাকে ঢাকা মহানগর উত্তর শাখা সংগঠনের বৃহত্তর স্বার্থে তার সদস্য পদ মুলতবি করে বাতিলের জন্য দলের আমীরের কাছে সুপারিশ করা হয়। যুগান্তর

সর্বশেষ