শিগগিরই চীন ও ভারত যাচ্ছে প্রতিনিধি দল * টার্গেট- নতুন নির্বাচন ও খালেদা জিয়ার মুক্তি
কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে নতুন করে তৎপরতা শুরু করেছে বিএনপি। প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।
এরই অংশ হিসেবে শিগগির চীন ও ভারত সফরে যাচ্ছে বিএনপির একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল। একাদশ সংসদ নির্বাচনের নানা অনিয়ম তুলে ধরে দ্রুততম সময়ে একটি নতুন নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করাই তাদের মূল লক্ষ্য।
পাশাপাশি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ত্বরান্বিত করতেও প্রভাবশালী দেশগুলোর সহযোগিতা পেতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে দলটি। এসব লক্ষ্যকে সামনে রেখে ইতিমধ্যেই ঢেলে সাজানো হয়েছে কূটনৈতিক উইং। এ উইংয়ের সদস্যরা নতুনভাবে কর্মপরিকল্পনা তৈরিতে কাজ শুরু করেছেন। বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, বিগত একাদশ নির্বাচন নিয়ে বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো আপত্তির পাশাপাশি এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে।
নির্বাচনের পর আমরা তাদের বিষয়টি অবহিত করেছি। বিগত নির্বাচনের অনিয়ম এবং সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডগুলো বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোকে তথ্যপ্রমাণসহ অবহতি করা হবে। ইতিমধ্যে এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন। তিনি বলেন, উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে বিএনপির সুসম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্ক আরও জোরদার করতে আমরা কাজ করছি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর প্রভাবশালী দেশ চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। যা দীর্ঘদিন বহাল ছিল। কিন্ত ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি সরকারের নেয়া কিছু উদ্যোগে দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। ওই সময় ঢাকায় তাইওয়ান টাওয়ার ও দেশটির জন্য ভিসা সেন্টার চালুকে কেন্দ্র করেই মূলত এ দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এরপর নানা উদ্যোগ নিলেও সম্পর্ক আগের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেনি দলটি।
বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তারা চীনের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক তৈরি করে যা এখন উচ্চপর্যায়ে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক জোরদারে উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে নতুন একটি চ্যানেলে যোগাযোগ শুরু করেছে দলটির হাইকমান্ড।
অতীতের কর্মকাণ্ডের জন্য দুঃখ প্রকাশের পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে চীনকে পাশে পেতে চায় দলটি। এ লক্ষ্যে শিগগিরই বিএনপির একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল চীন সফরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী মাসেই তারা চীন সফরে যেতে পারেন।
আরও জানা গেছে, চীনের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদারে ফের তৎপরতা শুরু করেছে দলটি। বিগত জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক আগের তুলনায় বেশ জোরদার হয়েছিল।
কিন্তু নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোট ও তাদের ধানের শীষ প্রতীক দেয়ায় বেঁকে বসে দেশটি। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে বিএনপির প্রতি দেশটির অবস্থান পাল্টে যায়। যার প্রভাব নির্বাচনে পড়ে বলে মনে করেন দলটির নেতারা।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ফের দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে চেষ্টা চালাচ্ছে দলটি। এজন্য দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা কাজ করছেন। সময় সুযোগ বুঝে তাদের ভারত সফরে পাঠানোর পরিকল্পনাও রয়েছে।
সূত্র জানায়, উন্নয়ন সহযোগিতায় বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর কূটনীতিকদের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ করছে বিএনপি। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্যসহ শক্তিধর দেশগুলোর কূটনীতিকদের বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি। দেশগুলোর সঙ্গে নতুন করে সম্পর্কোন্নয়নে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সম্প্রতি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন দলটির একজন নীতিনির্ধারক। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাকে অবহিত করা হয়। ওই নেতা জাতিসংঘের বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধির সঙ্গেও বৈঠক করেন।
সূত্র জানায়, নির্বাচনের পর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সিঙ্গাপুর থেকে তিনি যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে দেশটির কংগ্রেস সদস্য ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তিনি। বৈঠক অনেকটা ফলপ্রসূ হয়েছে বলে ওই সূত্রটি জানায়।
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি ত্বরান্বিত করতে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের চেষ্টা চালাচ্ছে দলটি। এ ইস্যুতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।
তবে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে বেশ ইতিবাচক সৌদি আরব- এমন মন্তব্য করে দলটির একজন নীতিনির্ধারক বলেন, বিষয়টি নিয়ে সেই দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে।
গত এক দশক ধরে কূটনৈতিক উইং বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অবদান রাখতে পারেনি। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রভাবশালী দেশগুলোর ইতিবাচক সহযোগিতা পায়নি দলটি। এক সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও বিএনপির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ফলে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আদায়ে প্রভাবশালী দেশগুলোর সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয় তারা।
এমনকি ভোটের পরও বন্ধু দেশগুলো নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ নিয়ে বিএনপির অভিযোগের পক্ষে জোরালো কোনো অবস্থান নেয়নি। উল্টো নির্বাচনের পর প্রায় সব দেশেই নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানায়।
এমন পরিস্থিতিতে অনেকটা বেকায়দায় পড়ে বিএনপি। নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে তথ্যপ্রমাণ থাকার পরও শুধু কূটনৈতিক সম্পর্ক অবনতির কারণেই তা সম্ভব হয়নি বলে মনে করছেন দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতা।
তারা মনে করেন, অতীতেও দলের হাইকমান্ড এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পরও সরকারকে কোনো চাপে ফেলতে পারেনি।
অন্যদিকে খালেদা জিয়ার শাস্তি ইস্যুতে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কোনো চাপের মুখে পড়তে হয়নি সরকারকে। খালেদা জিয়া কারাবন্দি থাকার পরও এ ইস্যুতে জাতিসংঘের মহাসচিবের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি ছাড়া এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক কোনো চাপ আসেনি বলে জানিয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। এমন পরিস্থিতিতে দলটির কূটনৈতিক উইং ঢেলে সাজানো হয়। ভাগ করে দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট নেতাদের দায়িত্বও।
জানতে চাইলে বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের অন্যতম সদস্য ও দলের বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনের পর নতুন একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে আমরা সবকিছু নতুন করে শুরু করেছি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নানা অনিয়মের বিষয়টি বাংলাদেশে নিযুক্ত কূটনীতিকদের আমরা ইতিমধ্যে অবহিত করেছি। তারা নিজেরাও নানা মাধ্যমে বিষয়টি অবহিত হয়েছেন। একতরফা নির্বাচন হয়েছে বলে আমরা যে দাবি করে আসছি সে ব্যাপারে তাদের নৈতিক সমর্থন রয়েছে।
তিনি বলেন, এ মুহূর্তে আমরা দুটি বিষয়কে সামনে রেখে এগোচ্ছি। দল গোছানোর সঙ্গে সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপরও জোর দেয়া হয়েছে। আমরা দলীয়ভাবে যদি সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে না পারি তবে বিদেশিরা আমাদের কিছুই করবে না। রাজনৈতিকভাবে আমরা শক্তিশালী হলে তারা এ বিষয়ে গুরুত্ব দেবে। আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি। যুগান্তর