‘ঘুষ ছাড়া’ মেধা-যোগ্যতায় নিয়োগে পুলিশের দৃষ্টান্ত

 

- Advertisement -

এবারই প্রথম ‘ঘুষ ছাড়া’ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পুলিশের ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে নিয়োগ পেয়েছেন ৯৬৮০ জন। এরমধ্যে ৬৮০০ জন পুরুষ ও ২৮৮০ জন নারী। তাদের খরচ হয়েছে মাত্র ১০৩ টাকা। ধন্যবাদ পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. জাবেদ পাটোয়ারী ও ৬৪ জেলা পুলিশ সুপারকে। পুলিশ মহাপরিদর্শকের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও গোয়েন্দা নজরদারির কারণে অতীতের সকল নিয়োগ থেকে আলাদা হয়েছে এবারের নিয়োগ পরীক্ষা। এবার নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকেই নৈশ প্রহরী, দর্জি, দিনমজুর, শ্রমজীবী, এতিম, অতিদরিদ্র কৃষক, রিকশা-ভ্যানচালক, গৃহপরিচারিকার কাজ করে এমন পরিবারের সন্তান। আগের নিয়োগ পরীক্ষাগুলোতে এমন পরিস্থিতি কল্পনাই করা যেতো না।

এবার কনস্টেবল নিয়োগের প্রায় এক মাস আগে থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা, জেলা ও উপজেলা তথ্য অফিসের মাধ্যমে মাইকিং করা হয়েছে। কেউ যাতে দালালচক্রের ফাঁদে পড়ে অর্থনৈতিক লেনদেন না করেন। সেজন্য পোস্টারিং ও লিফলেট বিতরণও করা হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর পর প্রাথমিক বাছাইপর্ব থেকে সব পরীক্ষায় প্রার্থীরা কারও সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেন করেছে কিনা সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এছাড়া আর্থিক লেনদেনসহ সব অনিয়ম ও সুপারিশ পরিহার করে সুষ্ঠুভাবে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের বিষয়টি সম্পন্ন করতে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছিল।

এদিকে পুলিশের চাকরি দেয়ার নামে ঘুষবাণিজ্যসহ অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ার তথ্যপ্রমাণ পাওয়ায় একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ অর্ধশত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এসব পুলিশ সদস্যের অধিকাংশের বিরুদ্ধে চাকরি থেকে বরখাস্ত, অন্যত্র বদলিসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে কুড়িগ্রামে নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিপন কুমার মোদককে খাগড়াছড়ি ও এসআই আবু তালেবকে বরিশাল রেঞ্জে বদলি করা হয়। ঘুষের টাকা ২৩ লাখ উদ্ধার করে বরখাস্ত করা হয়েছে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের হিসাবরক্ষক আবদুল মান্নান ও উচ্চমান সহকারী ছকমলকে। ডিআইজি অফিসে ক্লোজ করা হয়েছে স্পিড বোর্ড ড্রাইভার সাইদুর রহমান ও রেশন স্টোরের ওজনদার আনিছুর রহমানকে। এছাড়া রংপুর ডিএসবি শাখার এএসআই রুহুলকে ১০ লাখ টাকাসহ কুড়িগ্রামে আটক করা হয়। পরে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এমনকি ঘুষ কেলেঙ্কারিতে টাকাসহ ধরা পড়া একাধিক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে নিয়মিত মামলাও করা হয়েছে। ঘুষ বাণিজ্যের সাথে সংশ্লিষ্টতায় পুলিশ সদস্য গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আটক রয়েছেন। বিষয়টি সাংবাদিকদের নিকট স্বীকার করেছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) সোহেল রানা।

সংবাদ মাধ্যমে পুলিশ সুপাররা জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধকারী বাহিনী বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি অব্যাহত রাখতে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রেখে শুধু মেধা এবং প্রয়োজনীয় যোগ্যতার ভিত্তিতেই এবারে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়েছে। এই নিয়োগের ক্ষেত্রে কোথাও যাতে কোনও আর্থিক লেনদেন বা অন্য কোনও অনিয়ম না হয় সে ব্যাপারে গোপন তৎপরতা অব্যাহত রেখেই কনস্টেবল নিয়োগে সুষ্ঠুভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, গত ২৪ মে একটি দৈনিক পত্রিকায় কনস্টেবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট রেঞ্জের অধীনে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ লাইনস ময়দানে পর্যায়ক্রমে ২২, ২৪, ২৬, ২৯ জুন ও ১, ৩ জুলাই সরাসরি শারীরিক মাপ ও শারীরিক পরীক্ষা (দৌড়, রোপিং, জাম্পিং ইত্যাদি) হয়। এ ধাপে যোগ্য প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিতদের ৪০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়। এ পরীক্ষায় ৪৫ শতাংশ নম্বর পাওয়া প্রার্থীরা সর্বশেষ ধাপের পরীক্ষা (মনস্তাত্ত্বিক ও মৌখিক, ২০ নম্বর) নিয়ে সারাদেশে পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হয়। সংবর্ধনা দেয়া হয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের। উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্যেই এবারই এতিম, অতিদরিদ্র কৃষক, নৈশ প্রহরী, দর্জি, দিনমজুর, শ্রমজীবী, রিকশা-ভ্যানচালক, গৃহপরিচারিকার কাজ করে এমন পরিবারের সন্তান রয়েছে।

নিয়োগপ্রাপ্তদের পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে ছয় মাস মেয়াদি মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। টিআরসি প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে প্রশিক্ষণকালীন প্রতি মাসে প্রশিক্ষণভাতাসহ বিনা মূল্যে পোশাক, থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসার সুবিধা দেওয়া হবে। প্রশিক্ষণ শেষে কনস্টেবল পদে নিয়োগ দিয়ে বেতন ধরা হবে ‘জাতীয় বেতন স্কেলের (২০১৫) ১৭তম গ্রেডে ৯,০০০-২১,৮০০ টাকা বেতন। নিয়োগপ্রাপ্তরা অন্যান্য ভাতা ও রেশন পাবেন। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতিসহ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়ারও সুযোগ থাকছে।

‘ঘুষ ছাড়া’ নিয়োগপ্রাপ্তদের একজন হলেন সিরাজগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বহুলী গ্রামের পিতৃহারা হাসান। তার বড় ভাই শাহ আলম বিয়ে করে মা-ভাইকে ফেলে স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে উঠেছেন। বাধ্য হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয় হাসানকে। সংসার চালাতে রিকশা চালানোর পেশা বেছে নেন। পরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। লেখাপড়া করে বড় কিছু করার স্বপ্ন থাকলেও জীবিকার তাগিদে সেটা হয়নি হাসানের। তবে ভাগ্য তার দিকে মুখ ফিরিয়েও থাকেনি। তবে গত ৯ জুলাই মঙ্গলবার সিরাজগঞ্জ পুলিশ লাইন্সে ড্রিল শেড ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে ফলাফল ঘোষণার সময় নিজের নাম শুনে খুশিতে কেঁদেই ফেলেন তিনি।

সংবাদ মাধ্যমকে নিয়োগপ্রাপ্ত হাসান বলেন, মাত্র ১০৩ টাকায় পুলিশে পুলিশে চাকরি পাবো এমন ধারণা ছিল না। তবুও বন্ধুদের সঙ্গে আবেগে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকে গেলাম। তারপর লিখিত পরীক্ষাতেও টিকে গেলাম। তারপরও মনে হচ্ছিল আমাদের মতো গরিব মানুষের চাকরি হবে না। কারণ আমরা তো টাকা দিতে পারবো না। মৌখিক পরীক্ষাতে ঠিকই বাদ পড়ে যাবো। মৌখিক পরীক্ষাও ভালোভাবে দিলাম। চূড়ান্ত বাছাইয়ের সময় আমার নাম বলায় আমি আর স্থির থাকতে পারিনি। আমার চোখে পানি চলে এসেছে। একই ভাবে নিয়োগ হয়-সলঙ্গার জগজীবনপুর গ্রামের ভ্যানচালক মোক্তার হোসেনের ছেলে রাকিবুল ইসলাম, উল্লাপাড়ার দমদমা গ্রামের মুদি দোকানি মনজিলের মেয়ে মুক্তি খাতুন, কামারখন্দের ঠাকুরঝিপাড়া গ্রামের তাঁতশ্রমিক সোবহান শেখের মেয়ে সাহিদা, দিনমজুর আনোয়ার হোসেনের ছেলে মনিরুজ্জামান, রিকশাচালক আব্দুল আব্দুল আলীমের মেয়ে আঁখি খাতুন। স্বচ্ছতার মাধ্যমে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলা সদরের হতদরিদ্র সাবের আহম্মেদের মেয়ে কাজল রেখা সোমা, হোমনা উপজেলার নিলখী নয়াহাটি গ্রামের সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হওয়া শহিদুল ইসলামের মেয়ে কোহিনূর আক্তার ও আদর্শ সদর উপজেলার মাঝিগাছা গ্রামের বেকার রফিকুল ইসলামের ছেলে স্যানেটারি মিস্ত্রী মেহেদী হাসানেরও চাকরি হয়েছে। গত ৮ জুলাই সোমবার দুর্নীতিকে ‘না’ বলে হাত তুলে নিয়োগপ্রাপ্ত সকলকে শপথবাক্য পাঠ করান পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম। পরদিন মঙ্গলবার জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্তদের ফুল দিয়ে বরণ করা হয়।

গত ১০ জুলাই বুধবার সিলেটে আয়োজিত মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গি বিরোধী মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বলেছেন, ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু। তারা চায় মানুষ নির্বিঘেœ বসবাস করুক। তারপরও সমাজে অপরাধ থেমে নেই। মাদকের ব্যাপারে আমাদের জিরো টলারেন্স রয়েছে। মাদক কারবারি ও সেবনকারী যেই হোক কঠোরভাবে দমন করবে পুলিশ। থানা হবে অসহায় ও নির্যাতিত মানুষের আশ্রয়স্থল। এখন থেকে কেউ যদি থানায় সাধারণ ডায়রি করতে যান, পুলিশ ভ্যারিফিকেশন সার্টিফিকেট চান, তবে হয়রানিতে পড়তে হবে না। যদি কোন কর্মকর্তা হয়রানি করেন, সরাসরি অভিযোগ করবেন। কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।’ স্বচ্ছতার মাধ্যমে কনষ্টেবল পদে পুলিশের চাকরি দেয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করায় পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিনের কথা কিছুটা হলেও মানুষের উপকারে লাগবে।

গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সচেতন মহল পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. জাবেদ পাটোয়ারী ও পুলিশ সুপারদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। অনেকেই লিখেন, ইতিহাসে এবারই প্রথম স্বচ্ছতার মাধ্যমে পুলিশের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এতে করে অনিয়ম-দূর্নীতি কিছুটা হলেও কমবে।

কথা হয়-গোয়েন্দা সংস্থায় নিয়োজিত এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, মহাপরিদর্শকের পক্ষ থেকে পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কনষ্টেবল নিয়োগ দেয়ার জন্য বারবার তদারকি করা হয়েছে। কিছু অসাধু ব্যক্তিকে টাকা লেনদেনের মাধ্যমে পুলিশে চাকরি দেয়ার প্রতারণা করায় আটক করা হয়েছে। তাছাড়া যারা টাকা দিয়ে চাকরি নিতে চেয়েছিলেন তাদেরকে লিষ্ট থেকেই বাদ দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার ওই ব্যক্তি বলেন, এবার রাজনৈতিক নেতাদের কোন তদবিরে কাজ হয়নি। স্বচ্ছতা মাধ্যমে ‘ঘুষ ছাড়া’ নিয়োগপ্রাপ্তরা মানুষের কল্যাণেই কাজ করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

এবার পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষার মত বাংলাদেশের অন্য সকল নিয়োগ ‘ঘুষ ছাড়া’ ও দুর্নীতি মুক্ত হলে নিয়োগপ্রাপ্তরা দুর্নীতি করতে একটু হলেও চিন্তা করবে। তারা সেবা প্রার্থীদের উপকার করবে। এগিয়ে যাবে স্বাধীন বাংলাদেশ।

সর্বশেষ