শেষ অবধি সবার আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ আবারও একটা ২০১৪ সালের স্টাইলে ভোটারবিহীন নির্বাচন ‘মহড়ার মাধ্যমে’ নিজেদের ‘অপরিসীম-বিজয়’ প্রদর্শন করে ক্ষমতায় বসল।। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ মাত্র সাতটি আসন ছেড়ে বাকি ২৯৩টি দখল করে নিয়েছিল। এবারও সেই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটাল তারা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার (সীমাবদ্ধতা ও অনাচারের ঘটনার পরও) কারণে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নির্বিঘ্নে ২০০টি আসন পেয়ে যেত, প্রায় ১০০টি আসন জাসদ, ভাসানী ন্যাপ, মোজাফফর-ন্যাপ, আতাউর রহমান খানের পার্টি ও অন্যসব বিরোধী দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতে নিতে পারত, তখনকার সমগ্র পরিস্থিতি দেশের ওই রকমই ছিল, সে সময়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ওই রকম মতই দিয়েছিলেন। কিন্তু খন্দকার মুশতাক আহমাদসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই সব আসন দখল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন।
তাতে করে আওয়ামী লীগ বিশাল জনপ্রিয়তা থাকার পরও দেশবাসীর কাছে, আন্তর্জাতিক-মানবগোষ্ঠীর কাছে ‘ক্রেডিবিলিটি’ হারিয়েছিল। যার পরিণাম হয়েছিল- ‘বাকশাল’, একদলীয় অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। অনেক অনাচারের ফলে, অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে, সরকার পরিচালনায় আওয়ামী লীগ পুরোপুরি একটা ব্যর্থ রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচন করল, ১৫৪ আসনে বিনা ভোটেই নির্বাচন হয়ে গেল। বাকি আসনের নির্বাচনে পাঁচ শতাংশ ভোটারও উপস্থিত হতে সাহসী হননি, প্রয়োজনও বোধ করেননি ভোটাররা। কিন্তু নির্বাচন জিতে আওয়ামী লীগ পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকল ‘গায়ের-জোরে’ এবং দেশটাকে ‘মগের-মুল্লুক’ বানিয়ে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে তো ‘বিশ্ব-কুখ্যাতি’ অর্জন করল। এক সময়কার একটা জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল প্রমাণ করল- তার কোনো কর্মী বা সংগঠক দেশের ভোটার-জনগণকে বুঝিয়ে পক্ষে এনে নির্বাচনে জিতে আসার যোগ্যতাই রাখে না, তাই পুলিশ, অন্যসব আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও আমলাগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রেখে ‘পরের দিনের ভোটের মহড়া’ প্রদর্শন করল।
আওয়ামী লীগ যা অনাচার করল, যে ভয়াবহ সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করল, বিরোধী দলের প্রার্থীদের একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল-জুলুম, পুলিশ ও অন্যসব আইন রক্ষাবাহিনীর লোকজন, গোয়েন্দা বাহিনীর লোকজন ও দলীয় সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে যেভাবে ‘গুম, খুন, ক্রসফায়ার’ ব্যবস্থায় হত্যাকাণ্ড চালিয়ে, মারপিট ও খুনাখুনি করে, প্রচণ্ড ভয়ভীতি প্রদর্শন করে, বিএনপির প্রার্থীদেরকে পাইকারি হারে জেলে ঢুকিয়ে রেখে এবং ভোট কেন্দ্রের বিএনপি ও অন্যসব বিরোধী দলের নির্বাচনী এজেন্টদের বাড়িছাড়া, এলাকাছাড়া করে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করল, তার নজির বিশ্বের কোথাও কি আছে?
ব্যাপক গণআন্দোলন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটাতে পারে সেই আশঙ্কায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ‘কথিত বিচার’-এর নামে একটা প্রহসন করে জেলে ঢুকিয়ে রাখল আওয়ামী লীগ সরকার। তারপর কোনোমতেই জামিন পেলেন না তিনি।
আর একের পর এক মামলা দিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে নাস্তানাবুদ করা হল। তার সুচিকিৎসায় বাধা দেয়া হল। ৭৩ বছর বয়স্ক একজন অপরিসীম জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা, যিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাকে অসীম নির্মমতায় একটা পরিত্যক্ত জেলখানার নির্জন প্রকোষ্ঠে রেখে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে অতিষ্ঠ করার অপচেষ্টা চালানো হল।
অন্য যে কোনো ব্যক্তি যেসব মামলায় সহজেই উচ্চ আদালতে জামিন পেয়ে যান, এমনকি নিম্ন-আদালতেও জামিন পেতে পারেন, সে ক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়াকে জামিন পাওয়া থেকে বঞ্চিত করা হল। একটায় জামিন হলে আরেকটাতে জামিন বাতিল করে।
আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্ব কেন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এতটা ভয় পান? এর যৌক্তিক কারণ কী? আছে, কারণ অবশ্যই আছে। এ সরকার গত দশ বছরে সড়ক-মহাসড়ক, রাস্তাঘাট, সেতু, ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণ, অসংখ্য ভবন নির্মাণসহ অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ (রেন্টাল বিদ্যুৎ প্লান্টের উৎপাদনসহ) নানা অবকাঠামো নির্মাণ কাজে যে অপরিসীম দুর্নীতি করেছে, তাতে তাদের একেকজনের বিরুদ্ধে যে মামলা চলবে তাতে জেল অবধারিত, আর একবার সেসব প্রমাণিত হয়ে গেলে, আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না কোনোদিন, এমনকি দলটি ‘মুসলিম লীগ’ মার্কা পরিত্যক্ত দলে পরিণত হতে পারে।
এখনকার ছাত্রলীগ ও যুবলীগ যেভাবে মোনায়েম খাঁর এনএসএফ বাহিনী বা তার চেয়েও খারাপ ধরনের সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত, সেটা দেখেই বোঝা যায়, শিক্ষিত ও বোদ্ধা, নিষ্ঠাবান এবং প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও ত্যাগী রাজনৈতিক কর্মী ও সংগঠক আওয়ামী লীগের মধ্যস্তর ও নিম্নস্তরে নেই, ছাত্রলীগ-যুবলীগে তো থাকার প্রশ্নই আসে না। তারা সবাই ব্যস্ত আমলাদের সঙ্গে নিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের আখের গোছাতে, রাষ্ট্রীয় সম্পদের হরিলুটে ভাগ বসাতে।
সর্বশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কর্মী ও সংগঠকদের, যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কোনো সাংগঠনিক কাজই করতে হয়নি, জনগণকে বোঝানোর জন্য প্রচার কাজও তেমন একটা চালাতে হয়নি। কেবল কিছু জায়গায় সন্ত্রাস ও মাস্তানি ছাড়া আর কিছুর মধ্যেই তারা ছিলেন না। এবার কাজ যা করার তা করেছে পুলিশ, অন্যসব আইন রক্ষাকারী বাহিনী আর সিভিল প্রশাসনের মধ্য ও নিম্ন পর্যায়ের আমলারা।
তারা ‘চমৎকার ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ করেছেন, নজিরবিহীন জালিয়াতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পাস করিয়েছেন- অবিশ্বাস্য হারে ভোটদানের নমুনা প্রদর্শন করে। এটা কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না- ভোটের ফলাফলের উদ্ভট হিসাব, কোনোভাবেই তা সঠিক প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
যেমন, কোনো আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পেল দুই-আড়াই লাখ ভোট, আর সেই আসনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী পেল ছয় হাজার, কিংবা নয় হাজার বা বারো হাজার ভোট। সবারই জানা- বিএনপির জনপ্রিয়তা এই হারে কমতে পারে না, এটার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। রাস্তাঘাটে, মাঠেঘাটে জনগণের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করলেই বোঝা যায়- কীভাবে জালিয়াতি করা হয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগের ‘যুক্তি-বুদ্ধিসম্পন্ন’ লোকগুলোও এ ধরনের ‘জাল-জুয়াচুরির ভোট’ অনুষ্ঠানের নিন্দা করেছে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনায়।
সবারই জানা, এ দেশের মানুষ কোনো অবস্থাতেই একটা রাজনৈতিক দলকে দু’বার বা তিনবার একটানা ক্ষমতায় দেখতে রাজি হয় না, কারণ তারা প্রশাসনিক কাজে বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কোনোভাবেই নতুন কিছু করার মতো উদ্ভাবনী কৌশল ও শক্তির অধিকারী নয়। বিশ্বের অন্য অনেক দেশের সুষ্ঠু-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও তা-ই দেখা যায়, তারাও প্রতি টার্মে নতুন নেতৃত্ব দেখতে চায়।
বিএনপির এবার ক্ষমতায় আসার চমৎকার সম্ভাবনা ছিল একটা নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে। তারপরও আওয়ামী লীগের একটা সম্ভাবনা ছিল- সেটা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের জনপ্রিয়তা এখনও অবশিষ্ট ছিল যা দিয়ে এ দলটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারত বিএনপির সঙ্গে।
হয়তো এভাবে জালিয়াতি না করা হলেও আওয়ামী লীগ ১৫১ আসন বা আরও কিছু বেশি আসন নিয়ে পাস করে আসতে পারত, যদি রাজনৈতিকভাবে সুস্থ প্রতিযোগিতার ধারায় তারা নিজেদের ভুলগুলো স্বীকার করে, তা শোধরানোর উপযুক্ত পন্থা বিশ্লেষণ করে নিজেরা জনসাধারণের দুয়ারে উপযুক্ত ধরনা দিতে পারত। সেটাই ছিল আওয়ামী লীগের জন্য সর্বোত্তম পন্থা। কিন্তু সেদিকে তারা গেলেন না।
সারা-দুনিয়া দেখল আওয়ামী লীগ আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ব্যালট ভরে রেখে, পরের দিনে (ভোটের দিনে) ‘নির্বাচন নির্বাচন মহড়া’ দেখিয়ে তথাকথিত নির্বাচন করে জিতে এসেছে। তাই বিশ্বের সুস্থ স্বাভাবিক কোনো মানুষ যে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, সে আওয়ামী লীগের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধও রাখে না এখন।
এ ধরনের স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান তার প্রাদেশিক গভর্নর মোনেম খাঁর সহযোগিতায় ক্ষমতা দখল করে রেখেছিল এক দশক প্রায়। তারপর কী হয়েছে? আইয়ুব খানকে বিদায় নিতে হয়েছে তার সাঙ্গপাঙ্গসহ! আমরা তো আওয়ামী লীগকে সেই স্বৈরাচারী ভূমিকায় দেখতে চাই না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তো অবশ্যই দেখেছেন- তার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো জনপ্রিয় নেতা নিরপেক্ষ, দক্ষ ও নিষ্ঠাবান সরকার পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত ‘গণতন্ত্র হত্যা প্রক্রিয়ার’ মাধ্যমে একদলীয় সরকার (বাকশাল ব্যবস্থা) ব্যবস্থা কায়েম করে অজনপ্রিয় হয়েছিলেন।
আমরা চাই, আমাদের দেশে একটা চমৎকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসুক। ভুল করেছেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব, কিন্তু সেই ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে পুরো জাতিকে। এখান থেকে, এ ভুলের জগৎ থেকে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাপনাকে বের করে আনতে হবে।
বিএনপির দায় হচ্ছে- এ দলটি প্রচণ্ড নিপীড়নের মুখে তার কর্মীদের রাস্তায় এনে একটি সফল গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, কারণ সে রকম ত্যাগী ও সাহসী কর্মী ও সংগঠক বিএনপির ভেতরে এখন হয়তো অতটা নেই। থাকলে তো বিএনপি চেয়ারপারসনকে বিচার প্রহসনে শত্রুতামূলক চক্রান্তে জেলের ভেতরে অসহায় দশায় পড়ে থাকতে হতো না।
তবে অবশ্যই আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চাই, কোনো রকম সন্ত্রাসী হামলার আন্দোলন আমরা দেখতে চাই না, আবার শান্তিপ্রিয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনকারীদের ওপরে পুলিশ-র্যাব ও অন্যান্য বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতাও দেখতে চাই না। আমরা দেশে একটা সত্যিকার গণতান্ত্রিক ও সুশাসনের সমাজ দেখতে চাই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার এই শেষ টার্মে (নিজে যেভাবে বলেছেন) আমরা তার মহানুভবতা ও গণতন্ত্রের প্রতি ভালোবাসা দেখতে চাই। বিএনপি মহাসচিব নতুন নির্বাচন দাবি করেছেন, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি যথার্থ নিঃসন্দেহে। সেটি হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যাতে কোনো রকম ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সুযোগ না থাকে, সত্যিকারের ভোট অনুষ্ঠানে প্রতিটি ভোটার তার নিজের ভোটটি নিজের ইচ্ছামতো প্রার্থীকে দিতে পারেন, কোনো ভয়ভীতির শিকার না হয়ে। এবং সেই অবস্থায় যে সরকার আসবে তা হবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার, সেটাই পারবে এ দেশের মানুষকে প্রকৃত সুশাসন দিতে।
খায়রুল কবীর খোকন : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব এবং সাবেক ডাকসু জিএস ও সাবেক সংসদ সদস্য
যুগান্তর