প্রিয় সংবাদ ডেস্ক:: সাগর-নদী ঘন সবুজ বন ও পাহাড় পরিবেষ্টিত দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ সমগ্র চট্টগ্রাম জেলা জুড়ে এখন অধিক ফলনের আশায় অতিরিক্ত সার কীটনাশক ও কৃত্রিম হরমোন ব্যবহার করে শাক-সবজি উৎপাদনে ঝুঁকে পড়ছেন চাষিরা।
দীর্ঘদিন ধরে এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত শাক-সবজি খাদ্য হিসেবে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে রয়েছে। নানা প্রকারের জটিল রোগে ছড়িয়ে পড়ছে মানব দেহে, তেমনি এসব কীটনাশক ব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র পড়ছে হুমকিতে।
অতিরিক্ত সার কীটনাশক ও কৃত্রিম হরমোন প্রয়োগে উৎপাদিত শাক-সবজি যেমন মানব দেহে বিভিন্ন রোগ ব্যধির অন্যতম কারণ হয়ে দাড়িয়েছে, তেমনি প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্রও রয়েছে হুমকির মুখে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
এক সময়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের চাষিরা দেশী জাতের শাক-সবজি চাষ করলেও বর্তমানে অধিক উৎপাদন ও লাভের আশায় তারা ঝুঁকে পড়েছেন হাইব্রিড শাক-সবজি উৎপাদনের দিকে।
হাইব্রিড শাক-সবজি উৎপাদনে চাষিরা নিজেদের অজ্ঞতাবসত কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে অতিরিক্ত সার কীটনাশও কৃত্রিম হরোমন ব্যবহার করে আসছে শাক-সবজি উৎপাদনে। দীর্ঘদিন ধরে একই নিয়মে শাক-সবজি উৎপাদন প্রক্রিয়া চলে আসার ফলে ইতোমধ্যে খাল-বিল পুকুর নালা ডোবা থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে দেশী জাতের মাছ এবং আসে পাশের জীববৈচিত্রও রয়েছে হুমকিতে। একই কারণে কোনো বিধি নিষেধ না থাকায় অধিক ফলনের আশায় চাষিরা বিদেশী জাতের হাইব্রিড শাক-সবজি চাষে অভ্যাস্ত হয়ে পড়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে দেশী সবধরনের শাক-সবজির বীজ, ইতোমধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ দেশী জাতের শাক-সবজি হারিয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী প্রশিদ্ধ সবজি চাষি আবদুল করিম তিনি বলেন, একসময় দোহাজারীতে দেশী জাতের বাঁধাকপি, ফুলকপি, মুলা, ঢেরস, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, টমেটু, বেগুন, খিরা, ফল, শালগম, গাজর, ধনেপাতা, বরবটি, লালশাক, পালংশাক, চাষ করেছেন, কিন্তু এতে উৎপাদন তেমন না হওয়ায় তারা এখন হাইব্রিড জাতের শাক-সবজি চাষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।
তিনি বলেন, এই অঞ্চলে এখন দোহাজারী জাতের শিম ও আলুর জাত এখনো টিকে আছে, তিনি বলেন, হাইব্রিড শাকসবজি চাষে রাসায়নিক সার কিটনাশক ব্যবহার ছাড়া উৎপাদন করা একে বারেই অসম্ভব। বীজ নিয়ে তিনি বলেন, আমরা এখন হাইব্রিড বীজের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। তিনি দুঃখ করে বলেন, এই হাইব্রিড বীজ এখন ১ টাকারটা ৫ টাকায় আর ৫ টাকার বীজ এখন ১০০ টাকায় ক্রয় করেতে হচ্ছে।
অর্গানিক পোল্ট্রি,ডেইরী, ফিসারিজ কৃষি চাষের অন্যতম উদোক্তা ডাঃ(ডিএইচএমএস) অধ্যাপক ফখরুল ইসলাম বলেন, আমাদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে,পরিবেশকে দুষিত না করে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পুষ্টিমান সমৃদ্ধ হাইব্রিড শাকসবজি উৎপাদন সম্ভব। এ জন্য সরকারী বেসরকারী সকলের দৃষ্টি ভঙ্গি পরিবর্তণ করে জৈব সার জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে আর এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত শাকসবজি হবে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিমান সমৃদ্ধ।
অতিরিক্ত সার ব্যবহার করে শাক-সবজি উৎপাদনের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কৃষি অধিদপ্তর চট্টগ্রামের তৎকালিন উপ-পরিচালক আমিনুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, পুরো বিশ্বই হাইব্রিড শাক-সবজি উৎপাদনের উপরে জোর দিচ্ছেন। তবে হাইব্রিড শাক-সবজি উৎপাদনে অবশ্যই পরিমিত ভাবে রাসায়নিক সার কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে যদি পরিমিত ভাবে কিটনাশক সার প্রয়োগ করে শাকসবজি উৎপাদন করা হলে তাতে পুষ্টিমানের কোন ক্ষতি হবেনা বা খাদ্য হিসেবেই তা কোন ভাবেই মানব দেহের ক্ষতি করবেনা ।
তিনি বলেন, সরকারী নির্দেশনা মোতাবেক উপজেলা পর্যায়ে সকল কৃষি অফিসার উপ-সহকারি কৃষি অফিসারের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে কৃষদেরকে পরিমিত সার কিটনাশক ব্যবহারের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয় ।
মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের পুষ্ঠি ও খাদ্য বিজ্ঞানের পরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ নজরুল ইসলাম বলেন, রাসায়নিক সার কীটনাশক ব্যহারের উৎপাদিত শাক-সবজির পুষ্টিমানে কোনো হেরফের হয় না। তবে শাক-সবজি উৎপাদনে অবশ্যই পরিমিত ভাবে রাসায়নিক সার ও কিটনাশক ব্যবহার করতে হবে। না হয় অতিরিক্ত সার কিটনাশক মানবদেহের জন্য ক্ষতির হয়ে দাড়াতে পারে, এই জন্য অবশ্যই চাষিদের সচেতন করতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক জয়েন্ট সেক্রেটারী আজাদুর রহমান মল্লিক বলেছেন, শাকসবজি উৎপাদনে অতিরিক্ত সার কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জীববৈচিত্রের অপূরণীয় ক্ষতিসাধিত হচ্ছে।
অতিরিক্ত সার কিটনাশক ও কৃত্রিম হরোমন প্রয়োগ শাকসবজি উৎপাদন প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়ের সাবেক প্রাণী বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী এই প্রতিবেদককে বলেন, অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হলে তা বর্ষা ও বৃষ্টিতে ধুয়ে খাল-বিলে পড়ায় দেশী জাতের মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, পরিমিত সার কীটনাশক ব্যবহার করাসহ শাকসবজি বাজারজাত করার সময় চাষীদের সতর্ক হওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজির সহযোগী অধ্যাপক ড. আতিয়ার রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, অতিরিক্ত সার কীটনাশক ও কৃত্রিম হরোমন প্রয়োগ করে উৎপাদিত শাক-সবজি আমাদের লাইভ সার্কেলের উপর মারাত্মক বিরুপ প্রভাব বিস্তার করছে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশে খাদ্য উৎপাদনে এসব রাসায়নিক সার কীটনাশক ও কৃত্রিম হরমোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সহনশীলতাকে প্রাধান্য দেয়া হলেও আমাদের দেশে এই সব ক্ষতিকর রাসায়নিক সার কীটনাশক ও হরমোন ব্যবহারের কোনো নিয়ম নীতি নাই বললেই চলে, ফলে এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত শাকসবজিসহ সবধরনের খাদ্য আমাদের লাইভ সার্কেলের ভিশন ক্ষতি করছে।
স্বাভাবিক ভাবে সরাসরি এইসব খাদ্য খাওয়ার ফলে আমাদের শরীরে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে তিনি বলেন, এক কথায় এই সব খাবার গ্রহণে শরীরের ভিতরে নাইট্রোজেন অক্সিজেনে প্রতিক্রিয়াশীল উপাদান তৈরী করছে ফলে মানব দেহে ক্যান্সার ডায়াবেটিস ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কাজেই আমাদেরকে খাদ্য উৎপাদনে শতর্ক হওয়ার পাশাপশি জৈবসার বালাই নাশক ব্যবহার। সূত্র:: নয়াদিগন্ত