কৃষি অর্থনীতিতে গতিসঞ্চারের প্রয়াস

 

- Advertisement -

প্রিয় সংবাদ ডেস্ক :: বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর তাণ্ডবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে অর্থনীতি। এ থেকে রক্ষা পায়নি আমাদের দেশও। করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে সমগ্র বিশ্বের মতো বাংলাদেশও গ্রহণ করেছে ‘ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন’ কর্মসূচি, যার কারণে রাস্তাঘাট, যান চলাচল, অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠী। স্থবির হয়ে গেছে অর্থনীতির চাকা। খুলনা জেলাকেও লকডাউন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

ফলে আন্তঃজেলা যান চলাচল বন্ধ রয়েছে, এমনকি জেলার অভ্যন্তরে স্বাভাবিক যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের সরবরাহ ও বাজার ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক যান চলাচলের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এটিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রান্তিক কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারে আনতে পারছেন না।

অনেক পচনশীল কৃষিপণ্য বিক্রয় করতে না পারায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে কৃষকরা না পারছেন লাভ করতে, না পারছেন উৎপাদনের খরচ তুলতে। এ অচলাবস্থা কৃষিপণ্য উৎপাদনে কৃষককে নিরুৎসাহিত করে তুলছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের আভাস দিয়ে দেশবাসীকে সম্ভাব্য প্রতি ইঞ্চি জায়গায় ফসল উৎপাদনের আহ্বান জানিয়েছেন। লকডাউনের অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে দেশবাসীকে শস্য, শাকসবজি ও তরিতরকারি উৎপাদনে শ্রম দিতে অনুরোধ করেছেন তিনি। কিন্তু লকডাউনের কারণে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত না হলে একইসঙ্গে শ্রম ও অর্থ বিনষ্ট হবে।

তাই কৃষি উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী ভাবনা থেকে উৎসাহিত হয়ে খুলনা জেলা প্রশাসন গ্রহণ করেছে বিভিন্ন উদ্ভাবনী উদ্যোগ, যা একইসঙ্গে স্থবির কৃষি অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার করেছে এবং জাতীয় উন্নয়নে ইতিবাচক অবদান রাখছে।

ভিশন : উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রান্তিক কৃষকদের কাছে সরাসরি কৃষিপণ্য ক্রয় এবং জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ‘বেসরকারি মানবিক সহায়তা সেলে’র আওতায় নিু-মধ্যবিত্তদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ এবং ডিজিটাল অ্যাপসভিত্তিক বিপণন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্থবির কৃষি অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার করা এবং জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখা।

মিশন : ক) ঘরে আবদ্ধ সাহায্য প্রার্থীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ঘরে পৌঁছে দিয়ে লকডাউনের সফল বাস্তবায়ন। খ) লকডাউনের কারণে বাজারে আসতে না পারা প্রান্তিক কৃষকদের জীবিকার সংস্থান। গ) ভোক্তা জনসমাগম এড়িয়ে, নির্বিঘ্নে বাসায় বসে মুদি পণ্য, গ্রোসারি আইটেম, ওষুধ ও নিত্যপণ্য ক্রয় করতে পারবেন।

ঘ) কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী তৃণমূল পর্যায়ের কৃষক সম্প্রদায় সহজেই অ্যাপটি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত কৃষি পণ্য বিক্রয়ের একটি প্লাটফরম পাবে। ঙ) দরকষাকষির ঝামেলামুক্ত সুবিধাজনক, বিশ্বস্ত উপায়ে খাদ্যসামগ্রী কেনাকাটা করা। চ) ই-কমার্স পদ্ধতির মাধ্যমে ২৪/৭ কেনাকাটার সুবিধা। ছ) দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিতে ডিজিটালাইজেশন পদ্ধতির ব্যবহার ক্রমশ বাড়বে।

জ) দুধ, ডিম ও মাংস গ্রহণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ। ঝ) খামারিদের উৎপাদিত পণ্যের জোগান ব্যবস্থা সচল রাখা। ঞ) ঘরে বসে নিরাপদ পুষ্টি প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ। ট) মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য হ্রাসকরণ।

খুলনা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে করোনা সংকট মোকাবেলার জন্য গঠন করা হয়েছে ‘বেসরকারি মানবিক সহায়তা সেল’। এ সেলে সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা, ব্যবসায়ীরা, রাজনৈতিক ব্যক্তিরা, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দফতর বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য অনুদান হিসেবে প্রদান করছেন। একইসঙ্গে জেলা প্রশাসন নিজস্ব অর্থায়নে কৃষিপণ্য ক্রয় করে বিতরণ করছে।

এক্ষেত্রে খুচরা বাজার থেকে পণ্য ক্রয় করে খাদ্য সহায়তা প্রার্থীদের হাতে তুলে দিলে শুধু তারাই উপকৃত হতেন; কিন্তু সেই প্রান্তিক কৃষক থেকে যেতেন অবহেলিত, তার পণ্য থেকে যেত অবিক্রীত। খুলনা জেলা প্রশাসন প্রান্তিক কৃষক ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষণ করেছে।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সরাসরি অর্থ সহায়তা প্রদান না করে অনুদানের অর্থে প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে কৃষি পণ্য ক্রয় করা হয়েছে।

কৃষকরা তাদের উৎপাদিত শস্য, শাকসবজি, তরিতরকারি, ফলমূল বিক্রি করছেন ‘বেসরকারি মানবিক সহায়তা সেলে’র কাছে। এতে উপকৃত হচ্ছে উভয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী; সচল রয়েছে বাজার ব্যবস্থাপনা; গতিসঞ্চার হয়েছে কৃষি অর্থনীতিতে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে স্থানান্তরিত কাঁচাবাজার ও কৃষিপণ্যের বাজারগুলোর কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা, প্রান্তিক কৃষক ও ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষিত হচ্ছে কিনা, তা দেখভালের জন্য জেলা প্রশাসন কর্তৃক নিয়মিত মনিটরিং ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে।

করোনা সংকটের কারণে দেশব্যাপী লকডাউনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রান্তিক কৃষক, পোলট্রি ও ডেইরি খামারিদের উৎপাদিত পণ্য সুষ্ঠুভাবে বাজারজাতকরণ এবং লকডাউনের ফলে ঘরে অবস্থানরত ক্রেতা সাধারণের কাছে ন্যায্যমূল্যে এসব পণ্য পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া ডিজিটাল উপায়ে স্বচ্ছ ও সহজতর করতে সৃষ্টি করা হয়েছে মোবাইল অ্যাপ ‘হাতের মুঠোয় কাঁচাবাজার’। এ অ্যাপের মাধ্যমে ‘ঘরে বসে কৃষি বাজার’ ও ‘ডিজিটাল সুন্দরবন প্রোটিন হাউস’ নামক দুটি কার্যক্রম চালু করা হয়েছে।

উদ্যোগটি বাস্তবায়নে খুলনা জেলা প্রশাসনকে সহযোগিতা করছে জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস, খুলনা ও কৃষি বিপণন অধিদফতর, খুলনা। এর পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সূচনা করা হয়েছে ‘কৃষকের হাসি’ নামক ডিজিটাল অ্যাপ, যার মাধ্যমে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গৃহীত এ কার্যক্রম সমন্বয় করছে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অফিস।

চলতি বোরো মৌসুমে করোনাভাইরাসের কারণে কৃষকদের ধান বিক্রয় কার্যক্রম নির্বিঘ্নে সম্পাদন ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য হ্রাসকরণে এ অ্যাপের ব্যবহার ইতোমধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

পরিশেষে বলা যায়, করোনা দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি যত কঠিন ও প্রলম্বিত হোক না কেন, যথোপযুক্ত পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিকল্প কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে অর্থনীতিকে সচল রাখতে আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ৎস্থবির কৃষি অর্থনীতিতে গতিসঞ্চারের উদ্দেশ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করে খুলনা জেলা প্রশাসনের উপরোল্লিখিত উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো সারা দেশে অনুসরণীয় হতে পারে।

সূত্র:: যুগান্তর

সর্বশেষ