রিয়াজুর রহমান রিয়াজ :: রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যম সেটা সবার জানা থাকলেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে জনমনেও প্রশ্নের কিন্তু কমতি নেই। আর গণতন্ত্রের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অপরিহার্য। গনমাধ্যম অবরুদ্ধ থাকলে দুর্নীতি, সন্ত্রাস বেড়ে যায় এবং গণতন্ত্র ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
বলা যায়, সমাজসেবার একটি আধুনিক রূপ হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা। আর সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাজ গঠনে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, মানুষকে সচেতন করে তোলে। তাই দেশ ও জাতি গঠনে একজন সাংবাদিকের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
অন্যদিকে গণতন্ত্র অবরুদ্ধ হলে গণমাধ্যম হারাবে তার পূর্ন স্বাধীনতা ।
তাই সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে একাধিক সংগঠন গড়ে উঠলেও সেগুলো সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন বন্ধে বা নির্যাতনের ঘটনার দ্রুত বিচারের দাবি আদায়ে কতোটা তৎপর তা নিয়ে জনমনে নানান প্রশ্ন রয়েছে।
আজ দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কতটুকু বিরাজমান তা বলার অপেক্ষা রাখা। বলা যায় গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতাকে একটি সীমাবদ্ধতার মধ্য আটকে রাখা হয়েছে।
ফলে নৈরাজ্য, দুর্নীতি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ক্রমান্বয় বেড়ে যাচ্ছে । জনগণের রাজত্বের পরিবর্তে কায়েম হচ্ছে দুর্বৃত্তদের রাজত্ব।
আর এই সংকট মোকাবেলায়
সাংবাদিক ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিকগণকে ঐক্যমতের ভিওিতে এ কঠিন অবস্থা নিরসনে এগিয়ে আসতে হবে।
তা না হলে দেশে দুর্বৃত্তদের পদচারণে সমাজব্যবস্থা আরো বিপন্ন হয়ে পড়ার সম্ভাবন রয়েছে। এমতাবস্হায় সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের সম্মেলিত প্রায়স খুবই জরুরী।
একদিকে সাংবাদিকদের কাছ থেকে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পাওয়ার আক্ষেপ যেমন সবার থাকে। অন্যদিকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস নৈরাজ্যের খবর প্রকাশ করে যখন সাংবাদিকরা গুম, খুন ও নির্যাতনের স্বীকার হয় তখন সাংবাদিক নেতাদের গ্রুপিং এর বেড়াজালে ওই বিপদগ্রস্ত সাংবাদিকের পাশে কেউ দাড়াতে চায় না। ফলে ওই সাংবাদিক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেএে অনেকাংশ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
এছাড়া সাংবাদিকদের মধ্যে বিভাজন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। সাংবাদিকদের মধ্যে নানা মত ও অনৈক্য সৃষ্টি করেছে এ বিভাজন। এই বিভাজন থেকে একে অপরের সঙ্গে বিরোধ জড়িয়ে পড়েছে। যা খুবই দুঃখজনক।
এছাড়া সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হওয়ার কারনেও নির্যাতিত সাংবাদিকরা বার বার নিষ্ঠুর বাস্তবতা সম্মুখিন হচ্ছে। কোন একটা বিষয়ে যদি সবার এক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে, তখন দেখা যায় রাজনৈতিকভাবে কেউ কেউ এটার ফায়দা নিতে চেষ্টাও করে। আবার কেউ কেউ সাংবাদিকদের চাকরির নিশ্চয়তা এখনও গড়ে ওঠেনি বলে সব কিছু মুখ বুঝে সহ্য করে নেন।
সেক্ষেত্রে সাংবাদিকদের নিজ স্বার্থে সব মতভেদ ভুলে গিয়ে আগে ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি। সাংবাদিকরাই হচ্ছে জাতির বিবেক। সমৃদ্ধ দেশ গড়তে গণমাধ্যমের ভূমিকা যেমন অপরিসীম। তেমনি সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকলে যেকোনো অপশক্তিকে প্রতিহত করাও সম্ভব।
দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠান বা প্রভাবশালী ব্যক্তির দুর্নীতি, অপকর্মের সংবাদ প্রকাশিত হলেই সংশ্লিষ্টরা সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ক্ষোভ মেটায়। মিথ্যা মামলায় হয়রানির স্বীকার হয় ওই সাংবাদিক। অনেক সাংবাদিক নিউজ কভার করতে গিয়ে আক্রমণকারীদের হামলার স্বীকারও হন। হামলায় অনেকে মারাত্মক আহত হয়ে পঙ্গু জীবনযাপন করেন।
এছাড়া সংবাদকর্মীরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শুধু আহত নয়, অনেকে নিহতও হয়েছেন। তাদের পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তা নেই। বিচারের আশায় আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে।
বর্তমান বাস্তবতায় দেশের সাংবাদিকরা কতটুকু নিরাপদ তা জনগণের কাছে দৃশ্যমান। কারণে-অকারণে সাংবাদিকদের দোষারোপ ও হয়রানি করা হয়ে থাকে। ফলে সাংবাদিকরা দিন দিন শঙ্কা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সাংবাদিকরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে বৈরী পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে।
★ সাংবাদিকদের উপর নিষ্ঠুরতার সংক্ষিপ্ত বিবরনী:-
গত ৯ জুলাই দুপুরে ঠাকুরগাঁও সদর থানায় সংবাদ প্রকাশের কারণে তিন সাংবাদিককে আসামি করে মামলা করেন ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে পরিচালক ডা: নাদিরুল আজিজ।
সেই মামলায় আসামি করা হয় তানভির হাসান তানু, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন ও জাগো নিউজ ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি, রহিম শুভ, নিউজ বাংলা২৪ ডট কম অনলাইনের ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি, আব্দুল লতিফ লিটু, বাংলাদেশ প্রতিদিন ও নিউজ২৪ চ্যানেল এর ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি।
১০ জুলাই শনিবার সন্ধ্যায় তানভীর হাসান তানুকে আটক করে ঠাকুরগাঁও থানা পুলিশ, তবে অসুস্হ হয়ে পড়ার কারনে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলেও হাতকড়া অবস্হায় তার হাত ছিল হাসপাতালের খাটের সাথে আটকানো। যা তখন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। পরবর্তীতে ১১ জুলাই তানভীর হাসান তানুকে আদালত জামিন দিলে তিনি মুক্ত হন।
গত বছরের ২৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরীর ব্যাটারি গল্লি নিজ বাসা থেকে সকাল ৯ টায় বের হলে পথে অপহরনের স্বীকার হন সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয় পএিকার চট্টগ্রামের স্টাফ রিপোর্টার গোলাম সরওয়ার। কয়েক দিন পর পরিত্যক্ত অবস্হায় অজ্ঞাত স্হানে তাকে ফেলে যায় অপহরণকারীরা। এবিষয় গোলাম সরওয়ার বাদী হয়ে চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানায় মামলাও দায়ের করেন।
গত বছর মার্চ ও এপ্রিলে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ভবন ও এলজিইডি ভবনে আমলাদের হাতে লাঞ্ছিত হন বেসরকারি টেলিভিশন ইটিভি’র সিনিয়র রিপোর্টার সাইদুল ইসলাম।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দি লেখক মুশতাক আহমেদ (৫৩) মারা যান। তিনি গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে ছিলেন।
এছাড়া পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে গত ১৭ মে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে পাঁচঘণ্টা ব্যাপী স্বাস্থ্য মন্ত্রাণালয়ে আটকে রেখে তাঁর ওপর যে নির্যাতন ও হেনস্তা করা হয় যা দেশের সকল সাংবাদিকের জন্য হুমকিস্বরূপ। সারাদিন শেষে প্রায় মাঝরাতে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকেও উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে করেনন সচেতন মহল।
২০১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে টেকনাফ থানা পুলিশ ঢাকা পল্লবী ভাড়া বাসা থেকে ধরে এনে কক্সবাজারের স্থানীয় সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তাফা খানের উপর কি ধরনের নির্যাতন ও নিপীড়ন চালানো হয়েছে তা দেশবাসীর জানা আছে । এছাড়া অবৈধ অস্ত্র, ইয়াবা, বিদেশী মদসহ ৬টি মামলা দিয়ে তাঁকে প্রেরণ করা হয় জেলে। অবশেষে দীর্ঘ ১১ মাস কারাভোগ করার পর ২০২০ সালের ২৭ আগষ্ট কক্সবাজার জেলা যুগ্ম দায়রা জজ ১ম আদালত ফরিদুল মোস্তফাকে জামিন প্রদান করেন। পরে তিনি মুক্ত হন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে বাংলাদেশে ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে। এছাড়া প্রতিমাসেই দেশের কোথাও না কোথাও সাংবাদিক নির্যাতন ও হেনস্থার ঘটনা ঘটছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ১১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন সাংবাদিক কারাগারে আছেন।
আর্টিকেল নাইনটিন-এর ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে গতবছর দুজন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, ৭৮ জন হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন, ১৬৬ জন সাংবাদিক হত্যা ও অপহরণের হুমকি পেয়েছেন, ৩৫টি মামলায় ৫৮ সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে, ১২টি ফৌজদারি মামলায় ২০ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং ৩১ সাংবাদিকের ক্যামেরাসহ গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম ভাঙা হয়েছে।
বেশ কয়েকটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে গত দু’বছর ধরে সরকারি অফিসে দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা ক্রমান্বয় বেড়েছে।
এছাড়া গত ৮ জুন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)’র প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, ২০২০ সালে সারা দেশে মোট ২৪৭ জন সাংবাদিক আক্রমণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে করোনাভাইরাসের মধ্যে সরকারের ভূমিকা নিয়ে লেখালেখির কারণে ৮৫ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা এবং একই আইনের মামলায় কারাবন্দী একজন লেখকের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন করার আক্রোশে একজন সাংবাদিককে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩-এ মামলা দায়ের ও কারাগারে পাঠানোর প্রসঙ্গও উঠে আসে।
এতে আরো বলা হয়- করোনার অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শৈথিল্য লক্ষ্য করা গেছে মন্তব্য করে টিআইবি পক্ষ থেকে বলা হয়, দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিমালিকানাধীন কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আইনের আওতায় আনা হয়নি।
সাংবাদিক নেতারা মনে করেন, সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময়ে আমলাদের দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করার প্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের ওপর তাদের আক্রোশ থেকেই যায়। তাছাড়া সাংবাদিক লাঞ্ছনার ঘটনায় অভিযুক্ত আমলাদের কারও বিচার না হওয়াটাও এ ধরনের ঘটনা ক্রমান্বয় বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাংবাদিক সংগঠনগুলো পেশাগত স্বার্থে যতোদিন একত্রিত না হতে পারবে, ততোদিন বাংলাদেশে মুক্ত গণমাধ্যম ও স্বাধীন সাংবাদিকতার চর্চা যে অসম্ভব তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পাশাপাশি সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তৃণমূল পর্যায়ের সাংবাদিকদেরও ভূমিকা রাখতে হবে।
পরিশেষে এতটুকু বলবো, দেশ তথা জাতির স্বার্থে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যম পাবে তাদের প্রাপ্য অধিকার সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি সেটাই প্রত্যাশা করছি।
লেখক
—————
সিনিয়র রিপোর্টার –
দৈনিক আমাদের নতুন সময়, চট্টগ্রাম।