চট্টগ্রাম থেকে মালয়েশিয়ার পেনাং বন্দরে যাওয়া একটি খালি কনটেইনারের ভেতরে পাওয়া গেছে এক ব্যক্তির লাশ। ‘এমভি সোয়াসদি আটলান্টিক’ নামের জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনার নিয়ে গত ১০ অক্টোবর মালয়েশিয়ার পেনাং বন্দরে নোঙর করে। সেখানেই নিরাপত্তাকর্মীরা কনটেইনারের ভেতর লাশ দেখতে পান। জাহাজের মেইন লাইন অপারেটর দক্ষিণ কোরিয়ার সিনোকের শিপিং লাইন্সকে এ ব্যাপারে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষ। তবে ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে দেশটি। এমন ঘটনায় চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আবারও প্রশ্ন উঠেছে। বন্দরের সুরক্ষিত এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সত্যিকার অর্থে কতটা নিশ্ছিদ্র- তা নিয়েও চলছে আলোচনা, শুরু হয়েছে তোলপাড়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে অতীতেও একাধিকবার খালি কনটেইনারে করে মানুষ চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর আইএসপিএস কোড অনুসরণ করা একটি প্রথম শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়নে মানতে হয় আইএসপিএস কোড। ২০০৪ সাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরও এই কোড অনুসরণ করে পরিচালিত হচ্ছে। বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে যুক্তরাষ্ট্র কোস্টগার্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী এখন পুরোপুরি ডিজিটাল করা হচ্ছে বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ডিজিটাল পাস ছাড়া ও ডাটাবেইজে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ছাড়া এখন আর কেউ প্রবেশ করতে পারছে না চট্টগ্রাম বন্দরে।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর জাতিসংঘের অধীন আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা বিভিন্ন বন্দরের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত ব্যবস্থা বা আইএসপিএস কোড প্রণয়ন করে। জাহাজ বা কনটেইনারে বিপজ্জনক পণ্য পরিবহন করে কেউ যাতে এটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করতে না পারে, সে জন্যই এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৪৮টি দেশের বন্দরে তা বাস্তবায়ন হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে এ উদ্যোগ প্রথম নেওয়া হয় ২০০৪ সালের ১ জুলাই। বাংলাদেশে আইএসপিএস কোড বাস্তবায়ন কার্যক্রম তদারিক করতে পদাধিকার বলে এ-সংক্রান্ত কমিটির প্রধান করা হয় সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে। বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে এর আগে ১৬ দফা নির্দেশনাও দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র কোস্টগার্ড প্রতিনিধি দল। সেই নির্দেশনার সব শর্ত এখনও পূরণ করতে পারিনি বন্দর কর্তৃপক্ষ।
খালি কনটেইনার পাঠানোর নিয়মে যা আছে :নিয়ম অনুযায়ী খালি কনটেইনার জাহাজে ওঠানোর আগে তা ডিপোতে ভালোভাবে চেক করতে হবে। সেখান থেকে বন্দরে প্রবেশের আগে এটি আবার রি-চেক করার কথা বন্দর কর্তৃপক্ষের। এমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার পরও কীভাবে খালি কনটেইনারে মানুষ চলে গেলে মালয়েশিয়ায়- তা নিয়ে দিনভর আলোচনা ছিল বন্দরে। চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘কনটেইনারটি চট্টগ্রাম থেকে গেলেও মানুষটি কোথা থেকে কীভাবে ঢুকেছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। সে বাংলাদেশি কিনা এটিও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মালয়েশিয়া থেকে এখনও কেউ আমাদের কিছু জানায়নি। তারপরও আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, ‘আইএসপিএস কোড মেনে কার্যক্রম পরিচালিত হলে কোনোভাবেই এমন ঘটনা ঘটত না। এবারও আমাদের কোনো না কোনো জায়গায় নিরাপত্তা দুর্বলতা ছিল। এ কারণে খালি কনটেইনারে চলে গেছে মানুষ। তবে এই মানুষটা চট্টগ্রাম থেকে গেছে কিনা তা এখনও নিশ্চিত নই আমরা।’
যা বলছে শিপিং লাইন্স :দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক সিনোকর শিপিং লাইন্সের ‘এমভি সোয়াসদি আটলান্টিক’ জাহাজের স্থানীয় প্রতিনিধি গ্লোব লিংক অ্যাসোসিয়েটস। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈনুল হক চৌধুরী বলেন, ‘মেইন লাইন অপারেটরের নির্দেশনা অনুযায়ী বিএম ডিপোতে রাখা ওই কনটেইনার মালয়েশিয়ায় পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত ৪ অক্টোবর ডিপো থেকে খালি অবস্থাতেই সেটি চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হয় এবং সেখানে জাহাজে তোলা হয়। জাহাজটি ৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রওনা দিয়ে ৯ অক্টোবর পেনাং পৌঁছায়। ১০ অক্টোবর এটি জেটিতে নোঙর করে। কিন্তু ১৪ অক্টোবর খালি কনটেইনারটি পেনাং বন্দর থেকে ডিপোতে নিয়ে যাওয়ার পথে নিরাপত্তাকর্মীরা দুর্গন্ধ পেয়ে সেটি তল্লাশি করলে মানুষের মৃতদেহটি পাওয়া যায়।’
বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ যা বলছে :বিএম ডিপো স্মার্ট গ্রুপের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। গত জুন মাসে কনটেইনার বিস্টেম্ফারণের ঘটনায় এখানে প্রাণ হারান ৫১ জন। সেই স্মার্ট গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ক্যাপ্টেন মইনুল আহসান বলেন. ‘যে কনটেইনার থেকে মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, সেটি ৪০ ফুট লম্বা। কনটেইনারটি আমরা ট্র্যাকিং করে দেখি গত ৪ অক্টোবর বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে আমাদের ডিপো থেকে খালি কনটেইনারটি বের করা হয়। তখন আমরা খালি দেখতে পাই। খালি কনটেইনারের ছবিও আমরা তুলে রাখি। এর পর কনটেইনারটি বন্দরে নিয়ে নিউমুরিং টার্মিনালের চার নম্বর জেটিতে অপেক্ষমাণ ‘এমভি সোয়াসদি আটলান্টিক’ নামের একটি জাহাজে তুলে দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল থেকে জাহাজটি ৬ অক্টোবর ভোরে মালয়েশিয়ার পেনাং বন্দরের উদ্দেশে রওনা হয়। সেখানে পৌঁছায় ৯ অক্টোবর। এর মধ্যে কোথায় কী হয়েছে, তা আমাদের জানা নেই।’
সূত্র : সমকাল