মো.মোক্তার হোসেন বাবু: চট্টগ্রাম নগরী দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র। প্রতিদিন লাখো মানুষ যাতায়াত করে, হাজারো পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, কনটেইনারবাহী ট্রেইলার শহরের রাস্তায় চলে। এ সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বের বড় অংশই পড়ে ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত পুলিশ সার্জেন্টদের উপর। কিন্তু কর্তব্য পালন করতে গিয়ে তাদের জীবনে নেমে আসে একের পর এক দুর্ভোগ, যা সাধারণ মানুষের চোখে ধরা পড়ে না।
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ভেতরে বর্তমানে প্রশাসনিক জটিলতা ও পদশূন্যতার বোঝা। প্রায় ৪০০টিরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য পড়ে আছে। এর প্রভাব পড়ে মাঠ পর্যায়ের সার্জেন্টদের উপর। যথেষ্ট কর্মকর্তার অভাব থাকায় দায়িত্ব ভাগ হয়ে যায় সীমিত সংখ্যক সদস্যদের মধ্যে। ফলে সার্জেন্টরা প্রায়ই দ্বিগুণ-তিনগুণ দায়িত্ব নিতে বাধ্য হন। সকাল থেকে রাত অবধি ব্যস্ততম মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে যানজট নিয়ন্ত্রণ করা, দুর্ঘটনা সামলানো, কিংবা ভিআইপি মুভমেন্ট সামাল দেওয়া সবই তাদের ঘাড়ে চাপে।
সরঞ্জাম ও যানবাহনের ঘাটতির অভাবে অনেক থানাই হামলার শিকার হয়ে অস্ত্র, যানবাহন ও কেস ডকুমেন্ট হারিয়েছে। সার্জেন্টদেরও অনেক সময় পর্যাপ্ত যোগাযোগ যন্ত্র, নিরাপত্তা সরঞ্জাম বা যানবাহন থাকে না। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে খোলা আকাশের নিচে দায়িত্ব পালন করতে হয়, অথচ আধুনিক ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট যন্ত্র বা পর্যাপ্ত হেলমেট, জ্যাকেট, এমনকি বিশ্রামের জায়গাও নেই।
ট্রাফিক পুলিশের মতো সার্জেন্টদেরও দীর্ঘ সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। দিনের পর দিন পর্যাপ্ত পানি পান না করে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকের কিডনির জটিলতা দেখা দেয়। অনেকে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিতে ভোগেন। প্রচন্ড গরমে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া, শীতে ঠান্ডায় অসুস্থ হওয়া যেন নিত্য ঘটনা। কিন্তু চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা বা স্বাস্থ্য বিমা সুবিধা তাদের জন্য নেই বললেই চলে। নানাবিধ স্বাস্থ্য ও শারীরিক সমস্যায় পড়তে হয়।
কম বেতন, অতিরিক্ত দায়িত্ব আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সার্জেন্টদের মানসিকভাবে চাপে রাখে। অনেক সময় দেখা যায়, লোকজন তাদের দুর্নীতির দায়ে দোষারোপ করে। কিন্তু বাস্তবে সার্জেন্টদের অনেকেই ন্যুনতম সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। পরিবার থেকে দূরে থেকে দায়িত্ব পালন করা, সন্তানদের সময় দিতে না পারা তাদের ব্যক্তিজীবনকেও প্রভাবিত করে।
চট্টগ্রামের মতো ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকায় সার্জেন্টদের দায়িত্ব পালন করা সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। মাদক, অস্ত্র বা চোরাচালান বিরোধী অভিযানে গেলে তারা হামলার শিকার হন। সম্প্রতি বন্দরের এলাকায় পুলিশের এক কর্মকর্তাকে আহত করার ঘটনা প্রমাণ করে যে, সার্জেন্টদের জীবনও সবসময় হুমকির মুখে থাকে।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন পুলিশ সার্জেন্ট দৈনিক নাগরিক সংবাদ প্রতিবেদককে বলেন,“সকাল ৭টায় ডিউটিতে আসি, কখন যে রাত ১০টা বেজে যায় টেরও পাই না। দুপুরে খাওয়ার সময়ও মেলে না, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এক গ্লাস পানি খেলেই আবার কাজে ফিরতে হয়। গাড়ির হর্ণ, মানুষের গালি, ধুলো আর ধোঁয়ার মাঝে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি, তবুও কেউ ভাবে না আমাদের শরীর-মন কতটা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মাস শেষে যা বেতন পাই, তা দিয়ে সংসার চালানোই দায় হয়ে যায়। অথচ মানুষ ভাবে আমরা হয়তো অনেক সুবিধা ভোগ করি।” অনেক সময় আমাদের বিরুদ্ধে সামাজিক চাপ ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে কর্মরত সার্জেন্ট পুলিশদের প্রশ্নের মুখে দাড় করানো হয়।
চট্টগ্রামের কর্মরত পুলিশ সার্জেন্টরা প্রতিদিন যে দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন, তা শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, বরং সমগ্র নগরীর যানবাহন ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, পুলিশ সার্জেন্টদের জন্য পর্যাপ্ত সরঞ্জাম, আধুনিক প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা ও আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করা না হলে নগরীর আইনশৃঙ্খলা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।