তফসিল পর্যন্ত ‘সমঝোতার পথে হাঁটবে’ বিএনপি

 

- Advertisement -

ডেস্ক রিপোর্ট : কারাবন্দী দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সামনে রেখে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। এর আগে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত সমঝোতার পথ খোলা রাখাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে দলটি। একই সঙ্গে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতেও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে একটি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠনে কাজ করে যাচ্ছে দলের নীতি নির্ধারকরা।

দলটির জ্যেষ্ঠ কয়েকজন নেতা এই প্রতিবেদককে বিষয়টি জানিয়েছেন।

বিএনপির নেতাদের ভাষ্য, নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবে কি পাবে না, সেটা নিয়ে ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে; তা এখনো স্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই রাজনীতিতে নানামুখী অস্থিরতা সৃষ্টির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সেটা আংশিক সত্য হলেও দেশের রাজনীতির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই তৃণমূল নেতাদের কাছ থেকে তাগিদ আসার পরও এই মুহূর্তে কঠোর আন্দোলনে না গিয়ে বাস্তবতার আলোকে পথ চলা জরুরি হয়ে পড়েছে।

বিএনপির কিছু নেতা মনে করছেন, রাজপথের আন্দোলনে দাবি আদায়ে জাতীয় ঐক্য গঠনে শুধু জামায়াত ইসলামীই একমাত্র বাধা নয়; বরং তার চেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বড় দল ও ছোট দলগুলোর মধ্যে ‘রাজনৈতিক ভারসাম্য’ সৃষ্টির বিষয়টি। কারণ বিএনপি বড় দল হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ছোট দলগুলো চাইবে রাজনৈতিক ভারসাম্য। আর বিএনপি এখনো ছোট দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে পারেনি। ফলে বিএনপিও এখন প্রায় নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে ছোট দলগুলার আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। নির্বাচন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিএনপি সবসময় প্রস্তুত। আলাদা করে প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে না। সে জন্যই নির্বাচনের পরিবেশ যখন হয়, তখনই অংশগ্রহণমূলক পরিস্থিতি বিরাজ করে। কিন্তু সেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনও তো নির্ভর করছে সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর। কাজেই সুষ্ঠু নির্বাচনের গ্যারান্টি না থাকলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না।

একটি বিষয় স্পষ্ট যে, সুষ্ঠু নির্বাচন মানেই কিন্তু সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নয়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। যেমন: সিটি করপোরেশন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কি সুষ্ঠু হয়েছে? সুষ্ঠু হয়নি। ফলে বিএনপিও সেই ধরনের সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, যে নির্বাচনে ‘‘আমার ভোট আমি দেব, আপনার ভোটও আমি দেব’’-এমনটা না হয়। সুতরাং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের গ্যারান্টি হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন।’

এক প্রশ্নের জবাবে গয়েশ্বর বলেন, ‘খালেদা জিয়ার কারামুক্তি ও আগামী নির্বাচন একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা মানেই এই নয় যে, খালেদা জিয়া কারামুক্তি পেলেই বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে চলে যাবে। এখানে শুধু খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ই নয়; বরং জনগণের ভোটের অধিকারের বিষয়ও জড়িত। কেননা বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে জনগণের জন্য দাবি আদায়ে আন্দোলন করে আসছে, সেই জনগণেই যদি ভোট দিতে না পারে তাহলেও নির্বাচনে যাবে, এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন দল অন্তত বিএনপি নয়।

সেই লক্ষ্য অর্জনে বিএনপির প্রথম শর্ত সরকারের পদত্যাগ, দ্বিতীয়ত সংসদ ভেঙে দিতে হবে। তৃতীয় শর্ত নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন এবং চতুর্থ হচ্ছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। তাই নেত্রী (খালেদা জিয়া) কাল মুক্তি পেলে পরশু দিনেই আমরা নির্বাচনে চলে যাব, এমন ধারণা করা অনর্থক।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সবসময় সংলাপে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়ার দাবি করে আসা বিএনপি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মুখে সংলাপের কথা শুনে বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রেখেছে।

এ বিষয়ে দলটির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতার ভাষ্য, ‘ওবায়দুল কাদের সংলাপ ইস্যুতেই সকালে এক কথা, বিকেলে আরেক কথা বলে আসছে। কাজেই কোন কথা তার, কোন কথা দলের, আর কোন কথা সরকারের, সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি কি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে বলছেন? তিনি বলেছেন, শর্তহীন আলোচনা হতে পারে। অথচ এই কথার মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেই তো একটি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। এখন তিনি যদি আবার বলেন, শব্দহীন আলোচনা, তাহলে কী হবে? কাজেই সংলাপ ইস্যুতে বক্তব্য স্পষ্ট হোক, তারপর বিএনপি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। ইচ্ছে হলে যেতেও পারে, আবার ইচ্ছে হলে নাও যেতে পারে।’

অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে সংলাপের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে বিএনপির শীর্ষ আরেক নেতা বলেন, ‘সংলাপ ইস্যুতে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে যদি কোনো আভাস পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রেও উচিত হবে, অল্প সময়ের মধ্যে সংলাপের বিষয়ে সাধারণভাবেই এগিয়ে যাওয়া, মূল কথাটা বলে ফেলা। আওয়ামী লীগ যেহেতু একদিন-দুইদিনের মধ্যেই কথা উল্টিয়ে ফেলে, কাজেই আমি মনে করি বিএনপিকে এরই মধ্যে এই সুযোগটা নিয়েই বলে দিতে হবে। রাজনীতিতে ‘‘গিভ অ্যান্ড টেক’’ বলেও তো কিছু আছে।

কাউকে না কাউকে তো কিছু ছাড় দিতেই হবে। কিছু দিয়ে কিছু নিয়ে যদি রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূরীকরণে সংলাপ করা যায়, তাহলেও কিন্তু একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। সংবিধানের বাইরে বাংলাদেশে অনেক কিছুই হয়েছে, হচ্ছে। কাজেই আমরা (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) যদি সিদ্ধান্ত নেই যে সংকট সমাধান করব, তাহলে সেটা সংবিধানের ভেতরে-বাইরে বলে কোনো বিষয় মুখ্য হবে বলে মনে করি না।’

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ডিসেম্বরের শেষের দিকে ভোট হওয়ার কথা। ক্ষমতাসীন সরকারও নির্বাচনকালীন ‘ছোট সরকার’ গঠনের তোড়জোড় চালিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনাকে প্রধান রেখেই অক্টোবরে হবে এই সরকার। অন্যদিকে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও নীতিগতভাবে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু দলটির মূল দাবি, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তি।

দলটির নেতাদের ভাষ্য, তারা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর কোনো ধরনের আস্থা রাখতে পারছেন না। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রশ্নে বর্তমান সরকারের ওপরও তাদের ভরসা নেই। এরপরও আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ইতোমধ্যে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা গুলশান কার্যালয়ে তিন দফা বৈঠক করেছেন। সেখানে নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়া, দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়াও রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যু উঠে এসেছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘প্রথমত একটি নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে এবং এর মূল দায়িত্ব সরকারের পক্ষ থেকেই আসতে হবে। তখনই সকল শ্রেণি-পেশাসহ সাধারণ জনগণও সেই নির্বাচন ইস্যুতে সাড়া দেবে, বিবেচনা করবে কোন ধরনের সরকার দেখতে চায় তারা। কোনো আন্দোলনকেই এড়িয়ে চলার সুযোগ নেই। প্রতিটি আন্দোলনেরই একটি লক্ষ্য আছে। এখন সরকার সেই আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া আমলে নেবে কি নেবে না, সেটা তার বিষয়।

যদি ভোটের প্রশ্ন আসে, তাহলে সরকারকে অবশ্যই হিসাব করতে হবে বিগত আন্দোলনে তার কী অর্জন-বিসর্জন হয়েছে। তবে সরকারের যদি ভোটের প্রয়োজন না হয়, সে ক্ষেত্রে তাদের কাছে আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া থেকেও নাই। তবে আমার বিশ্বাস, দেশে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তাহলে নবীনদের ভাবনার সঙ্গে পুরনোদের ভাবনায় মিল থাকবে, যা নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। হয়তো সবকিছু বিএনপির পক্ষে না থাকলেও বিপক্ষে যাবে না এবং সেখান থেকে কিছু পুরস্কার পাব, সেটা তো আশা করতেই পারি।’

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন সচিব বলেই দিয়েছেন, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের কোনো সুযোগ নেই। এর মাধ্যমে তারা সত্যিকার অর্থে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সব পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে এই সরকার ও কমিশনের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া, না যাওয়ার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। অথচ আমরা জাতীয় ঐক্য চাই। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন চাই। ইসির দায়িত্ব লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা। দলগুলোকে আস্থায় নেওয়া।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো হলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বর্জনের পথেই হাঁটবে বিএনপি। আমরা এখন পর্যন্ত বিশ্বাস করি, দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিয়েই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব। তবে আমরা চাইলেই তো হবে না। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। আমরা সব ধরনের প্রস্তুতিই নিয়ে রাখছি।’

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘দেশে দুইজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য। তাদের একজন খালেদা জিয়া, অন্যজন শেখ হাসিনা। কিন্তু, বাস্তবতা হলো— একজন জেলে, অন্যজন প্রধানমন্ত্রী থেকে নির্বাচন করবেন। এটা তো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না।

আমরা নির্বাচন করতে চাই। নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকারের পরিবর্তন হোক। কিন্তু নির্বাচনের নামে কোনো প্রহসনের খেলায় অংশ নিতে চাই না।’

দলটির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, ‘বিএনপির হাতে একটাই অস্ত্র, সেটা হচ্ছে জনগণ। আওয়ামী লীগ রাজপথে যা করতে পারবে, বিএনপির পক্ষে সেটা করা সম্ভব হবে? হবে না। কারণ, তাদের আচরণের সঙ্গেই আমাদের অমিল। তা ছাড়া সবার সবকিছু নাই, থাকে না। যেমন: বিএনপির ভোট আছে, ছোট দলগুলোর সেই ভোট নাই।

ছোট দলগুলোর ব্যক্তিত্ব আছে, বড় দলগুলোর দেখা যায়, সেটি কম। কাজেই জাতীয় ঐক্য সৃষ্টিতে একদলের ভোট, আরেকদলের ব্যক্তিত্ব বিনিময় হলে কিন্তু ভারসাম্য থাকে, তখন আর আসন সংখ্যা নিয়ে সমন্বয়হীনতা দেখা দিতে পারবে না।’ প্রিয়.কম

সর্বশেষ