কোটা সংস্কারের পক্ষে আমি নিজে কমপক্ষে মাস দুয়েক আগে থেকে লেখালেখি শুরু করি। এর অনেক আগে থেকে দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী ফেসবুকে, রাজপথে শান্তিপূর্ণ ও সৃজনশীল নানা উপায়ে কোটা সংস্কারের পক্ষে জনমত তৈরি করেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং শিক্ষক সমিতিসমূহ কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়েও আমরা অনেকে সব কোটার সংস্কার চেয়েছি। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে পড়াশুনার শেষে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অথচ ছাত্র-ছাত্রীরা নিজের চাকরির ব্যবস্থা এমনি এমনি চায়নি। চেয়েছে মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা করে নিজেদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা নিজেরাই করতে। আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় প্রতিবছর বিসিএস পরীক্ষার আয়োজন করে, ১২৩ গুণ বেতন বাড়িয়ে সরকারি চাকরির প্রতি একটা উন্মাদনা তৈরি করেছে সমাজে। আগে তো আমরা সরকারি চাকরির জন্য এতটা পাগল ছিলাম না। একটা যৌক্তিক, সাবলীল আন্দোলনের মাধ্যমে ছেলে-মেয়েরা একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে চেয়েছে।
দেশের সব যেহেতু প্রধানমন্ত্রীকে করতে হয়, ওরাও চেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মুখের কথা ছাড়া এরা ঘরে ফিরে যাবে না। এর আগে প্রধানমন্ত্রী একবার ঘোষণা দিয়েও ছিলেন যে, কোটার শূন্য পদ মেধা থেকে এনে পূরণ করা হবে। ছাত্র-ছাত্রীরা ঘরে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এক উল্টো সার্কুলার জারি করে পুরো পরিস্থিতি আবার গরম করে ফেলা হয়। আমলারা কীভাবে পুরো পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দিতে পারে, সেটি সার্কুলারটি পড়লে বোঝা যায়। কী আশ্চর্য, এই উল্টো সার্কুলার নিয়ে সরকারের কোনো মন্ত্রী, বা আওয়ামী লীগের কোনো বড় নেতাকে কিছু বলতে আমরা দেখিনি। অথচ এই একটি সার্কুলার কত বড় নাশকতা হিসেবে কাজ করেছে সেটি ভাবলে আতঙ্কিত হতে হয়। ওবায়দুল কাদেরের মত বড় নেতা ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে মিটিং করেছে, ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু পরে মতিয়া চৌধুরী আর আবুল মাল আব্দুল মুহিত অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করে মহাতুফানের জন্ম দেয়। শেষ পর্যন্ত বহুল আকাঙ্ক্ষিত এক ভাষণে পুরো দেশে শান্তি নিয়ে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার প্রতি দেশবাসীর ভালোবাসা ও আস্থার বিষয়টি হাইলাইট না করে, আওয়ামী লীগের বড় কয়েকজন নেতা পর্যন্ত এই আন্দোলনের পেছনে তারেক রহমানের হাত আছে বলে গলা ফাটাচ্ছেন। কী বুদ্ধি নিয়ে, কী অনুধাবন নিয়ে এই নেতারা এত বড় ‘নেতা’ হয়ে গেলেন, আমরা বুঝিনা। কিছু ছাত্রনেতা এবং কিছু কোটাধারী দেশের এতগুলো ছেলেমেয়েকে অবিরাম শিবির বলে আখ্যায়িত করেছে। তারেক রহমান এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ফোন দিয়েছিলেন। তারেক রহমান নিজে কী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন সেটা আমরা জানি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফোনের এ প্রান্ত থেকে কাঁচুমাচু হয়ে যে টোনে কথা বলেছেন, তাতে লজ্জায় আমাদের মরে যেতে ইচ্ছে করছে। এমন নির্লজ্জ, ব্যক্তিত্বহীন শিক্ষক আর দুর্নীতিগ্রস্ত এক নেতার ফোনে দেশের তরুণ সমাজ এত বড় আন্দোলন করে ফেলবে, এটা আওয়ামী লীগের এই অপরিণামদর্শী নেতারা ভাবলেন কেমন করে?
তারেক রহমান তার মায়ের জন্য কী করতে পারছেন? খালেদা জিয়া জেলে আছেন। দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় খালেদা জিয়াকে কারাগারে থাকতে বলেছেন আদালত। তারেক রহমান লন্ডনে বসে উল্টাপাল্টা বিবৃতি দেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাথে বেয়াদবি করেন। ইতিহাস বিকৃতি করেন। দেশের মানুষ তারেক রহমানকে জানে একজন ‘লাইনচ্যুত প্রিন্স’ হিসেবে। এমন একজন অগ্রহণযোগ্য নেতাকে দেশের মানুষের সামনে অযথা হিরো বানিয়ে উপস্থাপন করছে আওয়ামীলীগেরই কিছু নেতা, ভাবতে অবাক লাগে। গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জঙ্গিবাদ আর দুর্নীতির বাড়াবাড়ির ফলে মানুষ আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় এনেছিল। সে আস্থা এখনো অব্যাহত আছে। বিএনপি-জামাত হরতাল ডাকলে হরতাল হয় না। এতকিছু দেখেও নিজেদের দলের এবং নেত্রীর শক্তি সম্পর্কে এসব নেতার বোধোদয় হয় না, আশ্চর্যজনক এবং ভয়ের বিষয়।
লেখক: শেখ আদনান ফাহাদ, সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়