ডেস্ক রিপোর্ট : একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় নিয়ে চিন্তা থাকলেও সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াইটা বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী ইস্যুতেই করতে চায়। এ জন্য দলটি একদিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি রাখছে, অন্যদিকে পরিকল্পনা করছে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার। দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, আগামী ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জনসভার মধ্য দিয়ে ওই আন্দোলন শুরু করে অক্টোবরে তা তুঙ্গে নিয়ে যেতে চাইছে দলটি। এর আগে অবশ্য ‘উদারপন্থী’ দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য গড়ার কাজ চূড়ান্ত করবে বিএনপি।
দলীয় সূত্র মতে, কারাগারে থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মনোভাবও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে। তিনি আন্দোলন ও নির্বাচন দুটিরই প্রস্তুতি রাখতে বলেছেন নেতাকর্মীদের। এ ছাড়া সব বাধা দূর করে ‘বৃহত্তর ঐক্য’ গড়ে তোলার জন্যও তিনি কারাগার থেকে বার্তা দিয়েছেন।
গত ২৫ আগস্ট কারাগারে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে আগামীদিনের কর্মকৌশল সম্পর্কে দিকনির্দেশনা নেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরে ওই দিন বিকেলে এবং গতকাল রবিবারও দলের স্থায়ী কমিটির সভায় এ বিষয়ে তিনি কিছুটা অবহিত করেন। বৈঠকগুলোতে নির্বাচনের বিষয়ে খালেদা জিয়ার মনোভাবের কথা আলোচিত হয়। একটি সূত্রের দাবি, গ্রেনেড হামলা মামলার সম্ভাব্য রায় নিয়েও সভায় আলোচনা করেন নেতারা। এ বিষয়ে আজকালের মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে দলের অবস্থান জানানোর বিষয়েও মত দেন বেশ কয়েকজন নেতা।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন আন্দোলন ও নির্বাচন দুটিরই প্রস্তুতির কথা বলেছেন। এ ছাড়া বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য এবং ২০ দলীয় জোটের ঐক্য অটুট রাখার ওপরও তিনি জোর দিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, ‘দেশের ভোটাররা এখন বিএনপির পক্ষে বলেই সরকার বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে চাইছে। পাশাপাশি যেসব রায়ের কথা বলা হচ্ছে সেগুলো নিয়েও সরকারের ভেতরে দুরভিসন্ধি রয়েছে, এটি এখন পরিষ্কার। এর অর্থই হচ্ছে, সরকারের পায়ের নিচে মাটি নেই।’ তিনি বলেন, মুক্ত খালেদা জিয়াকে নিয়েই বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনের পথেই আছে এবং শেষ পর্যন্ত থাকবে। তবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে যেসব বাধা রয়েছে সেগুলো অবশ্যই সরকারকে দূর করতে হবে। পাশাপাশি খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করতে চাইছে, ভাঙতেও চাইছে। কিন্তু সরকারের সে উদ্দেশ্য সফল হবে না। নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি অবশ্যই রাজনৈতিক লড়াই শুরু করবে।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার অবশ্য মনে করেন, নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ ওই সময়কার পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচন একতরফা নাকি অংশগ্রহণমূলক হবে এমন প্রশ্ন যেমন আছে, তেমনি ইমারজেন্সি, স্বৈরতন্ত্র, নাকি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির হবে সেসব আলোচনাও আছে। সব দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে, নির্বাচনের বিরুদ্ধে নয়। তাই তো বলছি, সরকারকে খালি মাঠে গোল দিতে দেওয়া হবে না। কিন্তু নিরপেক্ষ সরকার, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে।’
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার রায় নিয়ে বিএনপিতে কিছুটা শঙ্কা কাজ করছে। দলের বেশির ভাগ নেতাকর্মীর ধারণা, ওই মামলার রায়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদ হিসেবে বিএনপিকে কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচিও দিতে হবে। কিন্তু ওই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আবার এখনই সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হোক, তা চাইছে না বিএনপির হাইকমান্ড।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা মনে করেন, তারেক রহমানের ইস্যুটি দলের নেতাকর্মীদের কাছে ‘স্পর্শকাতর’ হলেও এ নিয়ে আন্দোলন করা হলে জনগণ তাতে সাড়া দেবে না। বরং ওই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকার ব্যাপক ধরপাকড়ের সুযোগ পাবে বলে তাঁরা মনে করেন। ফলে নির্বাচনের আগে এমন সুযোগ দিতে রাজি নয় বিএনপি। তার চেয়ে নির্বাচনী ইস্যু অর্থাৎ নিরপেক্ষ সরকার, সংসদ ভেঙে নির্বাচন এবং খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে বিএনপি তফসিল ঘোষণার আগেই আন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষে। পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও দলটি নিয়ে রাখছে। কারণ বিএনপি নেতারা মনে করেন, সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীরা মুখে যত কথাই বলুন, নির্বাচনের আগে সরকার অবশ্যই চাপে পড়বে এবং সংসদ ভেঙে দেওয়াসহ কিছু দাবি মানতে রাজি হবে। তেমন পরিস্থিতিতে বিএনপির যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে অসুবিধা না হয় সে লক্ষ্যে দলটি প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে।
যদিও সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্যের বিষয়ে বিএনপির নতুন মূল্যায়ন হলো—সরকার বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করে ফেলতে চাইছে। আর নির্বাচনের মাত্র এক-দুই মাস আগে গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণার উদ্যোগকেও বিএনপি দেখছে সরকারের ‘কূটচাল’ হিসেবে। তাদের মতে, ওই রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার বিএনপিকে চাপে তথা নেতৃত্বের সংকটে ফেলতে চাইছে। বিএনপি মনে করে, সরকারের প্রথম লক্ষ্য হলো ওই রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে বিএনপি সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি যেন আন্দোলনে নামে এবং আবারও ব্যর্থ হয়। কারণ তাতে নির্বাচনের আগে সাংগঠনিকভাবে বিএনপি আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। কিন্তু বিএনপির হাইকমান্ড সরকারের এমন ফাঁদে পা দিতে চাইছে না। যদিও দলের মধ্যে তারেকের ঘোর সমর্থকদের একাংশের মধ্যে এ নিয়ে অতি উৎসাহ রয়েছে। তবে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা মনে করেন, তারেকের ইস্যুতে দু-একটি বিক্ষোভ মিছিল বা হরতালের মতো কর্মসূচি দেওয়া গেলেও নির্বাচনই বিএনপির মূল টার্গেট হওয়া উচিত। তাঁদের ভাষায় সরকারের পতন ঘটানো বা নির্বাচনে না গেলে তারেক বা খালেদা কাউকে মুক্ত করা যাবে না।
সূত্র : কালের কন্ঠ