মো.মুক্তার হোসেন বাবু : চট্টগ্রাম মহানগরীতে গণপরিবহন সংকট লেগেই আছে। মহানগরীর প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের জন্য মাত্র ছোট-বড় চার হাজার পরিবহন রয়েছে। যার ফলে প্রতিনিয়ত, স্কুল, অফিসগামী ও কর্মস্থলে যাওয়া মানুষগুলো দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।এদিকে চট্টগ্রাম শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা নিয়ে ১০ বছর মেয়াদি একটি মহাপরিকল্পনা তৈরির কাজ শুরু করেছে বিশ্বব্যাংক ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
খসড়া এ মহাপরিকল্পনায় দেখানো হয়েছে, চট্টগ্রাম শহরের ৭৫ শতাংশ যাত্রীই গণপরিবহন বা বাস সার্ভিস ব্যবহার করতে চান। যার জন্য প্রয়োজন সড়কের মাত্র ১৭ শতাংশ। অন্যদিকে প্রাইভেট কার চট্টগ্রাম শহরের মাত্র ৫ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করলেও সড়কের ২৯ শতাংশ দখল করে থাকে। এছাড়া রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা ৬ শতাংশ যাত্রী পরিবহনের বিপরীতে ২৭ শতাংশ সড়কজুড়ে বিচরণ করে। এদিকে চট্টগ্রাম মহানগরীর জনসংখ্যা দিন দিন বাড়লেও সে তুলনায় বাড়ছে না গণপরিবহন। এ নগরীর বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ হলেও তাদের জন্য গণপরিবহন রয়েছে প্রায় ৪ হাজার।
এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, গণপরিবহনের ব্যাপক চাহিদা সত্ত্বেও সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা ও প্রাইভেট কার নগরীর মাত্র ১১ শতাংশ যাত্রীর পরিবহন চাহিদা মিটিয়ে ৫৬ শতাংশ সড়ক দখলে রাখছে, যা চট্টগ্রাম শহরের আধুনিক ও নির্বিঘ্নে ট্রাফিক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, একটি বর্ধিষ্ণু নগরে শক্তিশালী ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য নূন্যতম ১০ শতাংশ গণপরিবহন প্রয়োজন। চট্টগ্রামে যানবাহনের সংখ্যা বাড়লেও গণপরিবহনের সংখ্যা খুবই কম। যেসব যানবাহন তুলনামূলক কম যাত্রী পরিবহন করে এবং সড়কের বেশির ভাগ অংশজুড়ে চলাচল করে, সেসব যানবাহনই অধিক বাড়ছে। একটি সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য গণপরিবহন বাড়ানোর বিষয়ে সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
তবে বাস সার্ভিস বৃদ্ধির বিষয়ে বিআরটিএ’র কর্মকর্তাদের অভিমত, আঞ্চলিক ট্রান্সপোর্ট কমিটির (আরটিসি) নিয়মিত সভায় পরিবহন মালিকদের উপস্থিতিতে গণপরিবহনে বিনিয়োগের বিষয়ে তাগাদা দেয়া হয়। কিন্তু লোকসানের অজুহাত তুলে ব্যবসায়ীরা বড় যানবাহন বা গণপরিবহনে বিনিয়োগের বিষয়ে অতটা উদ্যোগী নন। তবে সীমিত পরিসরে হলেও আগের তুলনায় বাসের সংখ্যা বাড়ছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগরীতে নিবন্ধিত হয়েছে ৩ লাখের অধিক যানবাহন। যার মধ্যে গণপরিবহনের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। নিবন্ধিত এসব গণপরিবহনের মধ্যে বাসের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ও মিনিবাসের সংখ্যা ২ হাজারের বেশি। প্রায় তিন যুগ ধরে নিবন্ধন হওয়া যানবাহনের ভিত্তিতে বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা প্রায় চার হাজার বিবেচনা করা হলেও এরই মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশি যানবাহন পরিত্যক্ত হয়েছে। ৬০ লাখ মানুষের এ শহরে গণপরিবহন অস্বাভাবিক কম বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এত কম সংখ্যক গণপরিবহন মহানগরীর যানবাহন ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে নাজুক করে তুলছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামে বাস ও মিনিবাসের রুট রয়েছে ১৩টি। এছাড়া হিউম্যান হলারের ১৬টি ও অটোটেম্পোর রুট রয়েছে ১৮টি। বিভিন্ন রুটে বাস-মিনিবাস, হিউম্যান হলার ও টেম্পো সার্ভিসের নির্ধারিত সিলিংয়ের সংখ্যা ৫ হাজার ৭৯টি হলেও এক-তৃতীয়াংশই খালি থাকে বিভিন্ন সময়ে। এছাড়া বাস-মিনিবাসের জন্য চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় ১০ নম্বর রুটে (কালুরঘাট থেকে সি-বিচ পর্যন্ত) সর্বোচ্চ ২৫৬টি বাসের সিলিং রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। এছাড়া শিল্প-কারখানা ও ইপিজেডের জন্য ২০০টি বাসের সিলিং নির্ধারিত থাকলেও ৬০টি সিলিং খালি রয়েছে। ফলে সকাল ও বিকালের বিভিন্ন সময়ে শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের জন্য অন্যান্য রুটের বাসগুলো চলে যায়। এতে সাধারণ যাত্রীরা বিভিন্ন সময়ে চরম যানবাহন সংকটে পড়ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বন্দরনগরীতে সড়ক স¤প্রসারণ, ফ্লাইওভার নির্মাণসহ একাধিক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সত্তে¡ও যানজটের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। সারা দেশের ব্যবসায়ী, ভ্রমণপিপাসু মানুষ এমনকি বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা বেড়ানো কিংবা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে চট্টগ্রাম ভ্রমণ করলেও শহরটির ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সেকেলেই রয়ে গেছে। ট্রাফিক বিভাগ বিভিন্ন সময়ে তদারকির মাধ্যমে যানজট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলেও একটি আধুনিক ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করতে হচ্ছে নগরবাসীকে। এজন্য গণপরিবহনের অপ্রতুলতাকেই দায়ী করছেন অনেকেই।