‘রাক্ষসের মতো’ মানুষ খেয়ে ফেলে সরকার : মান্না

 

- Advertisement -

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বর্তমান সরকারকে গুম ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী করে বলেছেন, এই সরকার রাক্ষসের মতো মানুষ খেয়ে ফেলে। তিনি উপস্থিত গুম হওয়া পরিবারের স্বজনদের উদ্দেশে বলেন, চোখের পানিকে বারুদে পরিণত করুন। ভোটের মাধ্যমেই এদেরকে পরাজিত করতে হবে।

মঙ্গলবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে ‘গুম হওয়ার ৫ বছর শেষ আর অপেক্ষা কতদিন’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। সভায় গুম হওয়া স্বজনদের অনেকেই বলেন, আমরা আর কাঁদতে চাই না, আমাদের প্রিয়জনকে ফিরে পেতে চাই। যাদেরকে গুম করা হয়েছে তাদের কি অপরাধ তা আমরা স্পষ্টভাবে জানতে চাই। এত অপেক্ষা করতে আর ভাল লাগে না। আমাদেরকে মেরে ফেলুন না হলে আমাদের প্রিয় মানুষদেরকে ফিরিয়ে দিন। গুম হওয়া ঢাকা মহানগরীর বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা খাতুনের সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা, গণসংহতি আন্দোলনের নেতা জোনায়েদ সাকি, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল সহ গুম ও নিখোঁজ হওয়া পরিবারের সদস্যরা।

গত ৬ বছরে গুম হওয়া বেশ কয়েকজনের পরিবারের সদস্যরা এই অনুষ্ঠানে নিজেদের স্বজনকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানান; অনেকে কান্নায়ও ভেঙে পড়েন। এসময় মান্না বলেন, কেঁদে কী করবেন? যারা ক্ষমতায় আছে, যারা কিছু করতে পারে আপনাদের জন্য, ওরা সবাই দায়িত্বজ্ঞানহীন, ওদের মানুষের জন্য কোনো দয়া নাই-দরদ নাই। ওরা রাক্ষসের মতো। রাক্ষস যেমন মানুষ খায়, এই সরকার মানুষ খেয়ে ফেলছে।

তিনি বলেন, আমি আগেও এই অনুষ্ঠানে এসেছি। দেখেছি স্বজনদের জন্য পুরো হল কান্নায় ভেঙে পড়েছে। যতজনের নিখোঁজের কথা বলা হচ্ছে, তারা সবাই কি বেঁচে আছে? কারা বেঁচে আছে, আর কারা বেঁচে নেই, এই কথা এরা (সরকার) বলবে না। এরা যতদিন ক্ষমতায় আছে, ততদিন আপনাদের কোনো প্রশ্নের জবাব পাবেন না। অতএব লড়াই একটাই, সেটা হচ্ছে এদের কবল থেকে মুক্তি চাই। তারপর আমাদের স্বজনদের ফিরে পাবার পালা। অতএব চোখের পানিকে বারুদে পরিণত করুন। ভোটের মাধ্যমে এদের পরাজিত করতে চাই, তাছাড়া পারবেন না।

তিনি উপস্থিত গুম হওয়া স্বজন ও অন্যদের উদ্দেশে বলেন, যেরকম বুকের মধ্যে ছবি নিয়েছেন, এভাবে বুকে ছবি নেন, ব্যানার নেন, প্ল্যাকার্ড নেন। নিজের এলাকায় যান, বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন যাকে পান, তাকেই বলেন, সামনে নির্বাচন এদেরকে জবাব দিতে চাই। আপনি যদি গুম খুনের জবাব চান। তাহলে ভোটের লড়াই করতে হবে। সামনে ভোট, এখন একমাত্র ভোটের লড়াই করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, গুম হচ্ছে সব থেকে জঘন্য অপরাধ। এটা খুনের থেকেও জঘন্য। পৃথিবীর বিভিন্ন আইনে এ ব্যাপারে যে সংজ্ঞা দেওয়া আছে, সেখানেও এটাকে চরম জঘন্য অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা আছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয়েছে- গুম বা খুন যখন পরিকল্পিত এবং ব্যাপক সংখ্যায় হয়, তখন সেটাকে আমরা মানবতাবিরোধী হিসেবে বলতে পারি। যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ হয়।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে যতগুলো গুমের ঘটনা ঘটেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিকার হয়েছেন সরকার বিরোধী যারা রাজনীতি করেন। কাজেই আমাদের ভাবার কারণ রয়েছে গুম হয়েছে পরিকল্পিতভাবে এবং সংখ্যার দিক থেকেও এটা ব্যাপক সংখ্যায় হয়েছে। আমি মনে করি, গুমের শিকার হওয়া যেসব পরিবার আছেন আপনারা যদি দেশে বিচার না পান, আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে এর বিচার পাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে চেষ্টা করবেন।

পাঁচ বছর আগে নিখোঁজ হওয়া ঢাকা মহানগরের ২৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনের বড় বোন মারুফা ইসলাম ফেরদৌসী অনুষ্ঠানে বলেন, আমার মতো আরো ২২ পরিবারের স্বজনরা এখানে উপস্থিত আছে। সবার দাবি, তাদের স্বজন ফিরে আসুক। সুমনের কিশোরী মেয়ে হাফসা ইসলাম রাইদা চিৎকার করে বলেন, বাবাকে খুঁজতে সব জায়গায় গেছি, কিন্তু কোথাও পাইনি। এ কেমন দেশ! এক বছর আগে নিখোঁজ হওয়া মারুফ জামানের ছোট মেয়ে সামিরা জামান বলেন, এক বছর হল, আমার বাবা নিখোঁজ হল, এখনো তাকে পাচ্ছি না। নিখোঁজ সোহেলের শিশু মেয়ে সাফা বলেন, ভালো লাগে না। বাবাকে নিয়ে স্কুলে যাব। নিখোঁজ আব্দুল কাদের মিয়া মাসুমের মা আয়শা আলী বলেন, আমরা সাধারণ নাগরিক, সন্তানই আমার সম্পদ। নতুন বছরে সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আশা করি। পুরান ঢাকার বংশালের নিখোঁজ আদনানের বাবা এরশাদ আলী, সেলিম রেজা পিন্টুর বোন রেহেনা বেগমও স্বজনদের ফিরে পাওয়ার আকুতি জানান। সিলেটে আহত ছাত্রদলের একজন কর্মী পুলিশের নির্যাতনের বর্ণনা দেন এই অনুষ্ঠানে।

মায়ের ডাকের পক্ষে আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, আমরা আমাদের সন্তানদেরকে হারিয়ে কষ্টে জীবনযাপন করছি। দেখতে দেখতে ৫টি বছর শেষ হয়ে গেলো। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মায়ের ডাকের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের প্রতি একটি দাবি রয়েছে- আর সেই দাবিটি হলো ‘দলীয় ইশতেহারে গুম হওয়ার বিষয়ে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের স্পষ্ট বক্তব্য থাকতে হবে’ অর্থাৎ যারা আগামীতে ক্ষমতায় আসবে তারা কি গুম ও খুনের পথ বেছে নেবে? নাকি এই পথ পরিহার করে মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেবে।

তিনি বলেন, যারা গুমের শিকার হয়েছে তাদের তদন্ত করে প্রতিবেদন তুলে ধরার জন্য একজন বিচারপতির নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির দাবি করছি। গত ৫ বছরে গুম হওয়া কেউ ফিরে আসেনি। কিন্তু গুম হওয়া পরিবারের অনেকেই কাঁদতে কাঁদতে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। মুন্নার বাবা যে এই প্রেসক্লাবে এসে সন্তানের ফিরে আসার দাবি জানিয়েছিল তিনি চিরদিনের জন্য আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন। মুন্নার মা ময়ুরী বেগম কাঁদতে কাঁদতে প্রায় অন্ধ। পারভেজ হোসেনের বাবা ও শ^শুর গত ৫ বছরে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তার ছোট্ট মেয়ে হৃদি এখন কাউকে দাদু-নানু ডাকতে পারে না। অনেকেই নির্বাক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আমরা আর কাঁদতে চাই না, আমাদের প্রিয়জনকে ফিরে পেতে চাই। যাদেরকে গুম করা হয়েছে তাদের কি অপরাধ তা আমরা স্পষ্টভাবে জানতে চাই। এত অপেক্ষা করতে আর ভাল লাগে না। আমাদেরকে মেরে ফেলুন না হলে আমাদের প্রিয় মানুষদেরকে ফিরিয়ে দিন।

সর্বশেষ