সৈয়দ আবুল কাসেম: “হেথায় দেখি হোতায় দেখি, তিল ধারণের ঠাঁই নাহি।
ঐ দেখা যায় ধর্মাবতার, নালিশ করব তারে আমার”। হ্যাঁ , আমি ফৌজদারী কার্য্যবিধি আইনের ১৪৫ ধারায় দায়ের হওয়া মামলা সম্পর্কে বলছি। আইনের ছাত্র মাত্রই জানেন এটি একটি আধা বিচারিক প্রক্রিয়া ( quasi judicial process)। এধারার মামলা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিসেট্রট আদালতে ফৌজদারী বিবিধ মামলা হিসেবে দায়ের হয়ে থাকে। এধারায় মামলা দায়েরের আইনানুগ লক্ষ্য সম্পর্কে বলতে হলে আমরা বলতে পারি, কোন স্থাবর সম্পত্তি সংক্রান্তে শান্তি ভঙ্গের বা আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার আশংকা দেখা দিলে তা রোধ করা। ফৌজদারী কার্য্যবিধির ১৪৫ ধারায় বিজ্ঞ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিসট্রেটের প্রসিডিং ড্রয়ের আদেশ দুই মাস পর্যন্ত বলবৎ থাকে। সম্পত্তির স্বত্ব নির্ধারণ করা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিসেট্রট আদালতের এখতিয়ার ভুক্ত নয়। আক্ষরিক অর্থে বিজ্ঞ এডিএম কোর্ট তা কখনো করেনও না। এডিএম কোর্ট দখলদারের দখল রক্ষার মাধ্যমে শান্তি শৃংখলা রাক্ষা করে, এমনকি তিনি প্রকৃত স্বত্বাধিকারী না হলেও। দখল চ্যুত স্বত্বাধিকারীকে দেওয়ানী আদালতের মাধ্যমে “স্বত্ব সাব্যস্ত ও খাস দখল পাওয়ার মোকদ্দমা”য় ডিক্রি লাভে করে তার স্বত্ব দখল ফিরে পেতে হবে। এটাই এসংক্রান্ত জুরিসপ্রুডেন্স। তাহলে বিভ্রাট কোথায়? বিভ্রাটা অন্য জায়গায়।
একজন ব্যক্তি যখন তার স্বত্ব -দখলাধীন জমি-জমা, বাড়ী-ঘর ইত্যাদি অর্থাৎ স্থাবর সম্পত্তি সংক্রান্তে অপেক্ষাকৃত শক্তিমান কোন পক্ষের দ্বারা দখল চ্যুত হবার শংকায় শঙ্কিত হয়ে দেওয়ানী আদালতের আশ্রয় গ্রহণের জন্য আইনজীবীর শরণাপন্ন হন তখনই প্রকৃত বিভ্রাটটা শুরু হয়। বিচার প্রার্থী আসন্ন হুমকি সংক্রান্তে তাৎক্ষণিক একটা প্রতিকার প্রত্যাশা করেন। কিন্তু বিজ্ঞ আইনজীবী তার পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান দ্বারা এটা জানেন বিচার প্রার্থীর প্রত্যাশা অনুযায়ী দেওয়ানী আদালত হতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বা অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার আদেশ পাওয়া খানিকটা অসম্ভব বৈ কি! তিনি আরো জানেন কি এক অদৃশ্য কারণে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার জন্য উত্থাপিত ইন্টারলোকেটারী পিটিশনগুলোতে সাধারণতঃ ১৫| ২১|৩০ দিনের কারন দর্শানোর আদেশ দেওয়া হয়। অনেক সময় বিবাদী পক্ষের প্রতি সেই কারন দর্শানোর নোটিশ জারি করাতে গিয়ে বাদী পক্ষ নিজের নাম পর্যন্ত ভুলে যায়। তারপর সেই নোটিশ পাওয়ার পর শক্তিমান বিবাদী দ্বিগুন উৎসাহে বাদীকে দখল চ্যুত করে দেয় এবং আদালতে হাজির হয়ে লিখিত আপত্তি দাখিলের জন্য নানান কল্পিত কারণ দেখিয়ে সময় নিতে থাকে যাতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার প্রার্থনায় দায়ের করা ইন্টারলোকেটারী পিটিশনের শুনানি বিলম্বিত হয়। আর যখন শুনানি হবে তখন যাতে বলতে পারে, সে তামাদির উরধ্ব কাল যাবত নালিশী ভূমিতে দখলে আছে। যাই হোক, বিচার প্রার্থী ব্যক্তির আইনজীবীর সামনে অবস্থা যখন এরকম তখন নিরুপায় আইনজীবী তার মক্কেলকে ফৌজদারী কার্য্যবিধির ১৪৫ ধারায় এডিএম কোর্টে মামলা দায়েরের পরামর্শ দেন। প্রায় অধিকাংশ মামলাতে বিজ্ঞ এডিএম কোর্টের আদেশে যে কথাটি লেখা থাকে তা হল,” ও. সি .—- থানা, নালিশী সম্পত্তিতে শান্তি শৃংখলা বজায় রাখুন। তদন্ত পূর্বক দখল বিষয়ে প্রতিবেদন দিন।” কাহিনীর চুড়ান্ত ক্লাইম্যাক্স এখনেই। বলতে বাধা নাই, আদেশেটি সংশ্লিষ্ট থানায় পৌছার পর দেওয়ানি আদালতের সকল কাজ সেখানে শুরু হয়ে যায় বলে ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন ।দখল বিষয়ে তদন্তের নামে উভয় পক্ষের কাগজ পত্র পরীক্ষা, সম্পত্তির স্বত্ব নির্ধারণসহ সব কিছু। এ বিষয়ে এখানে এর চাইতে বেশী বলা অনাবশ্যক।
সম্প্রতি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ
(মামলা না নিয়ে থানায় পুলিশের বিচার কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, মামলা না নিয়ে থানার ওসিরা কোন সাহসে নিজেরাই বিচার বসায়, সমঝোতার চেষ্টা করে? ওসিরা সব জায়গায় রাতে কোর্ট বসায় কিভাবে?সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানায় একটি মামলার ঘটনায় ওসির মধ্যস্থতা করার অভিযোগে করা এক রিট শুনানিতে মঙ্গলবার হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।আদালত বলেন, ১৩ হাজার পুলিশ থানায় বসে মামলার আগেই অভিযোগের সমঝোতা করে ফেলছে। এতে দুই পক্ষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত হচ্ছে না। গোটা পুলিশ বিভাগের বদনাম হচ্ছে তাতে।)থানায় বিচার বসানোর বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল মানুষ আদালত রেখে থানায় যেতে বাধ্য হয় কেন? নিন্ম আদালতগুলোর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের দায়িত্ব রয়েছে এ অসুখের প্রতিবিধান করার। একই সাথে দেওয়ানি বিচার কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন পর্যায়ের বিজ্ঞ বিচারকগণকেও এ বিষয়ে আরো সতর্ক ভূমিকা রাখতে হবে। তাৎক্ষণিক প্রতিকারের জন্য তাদের আদালতে উত্থাপিত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বা অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার ইন্টারলোকেটারী পিটিশনগুলোর প্রার্থীরা প্রয়োজনীয় নূন্যতম আইনগত শর্ত পুরণ করলে তারা যেন তাৎক্ষণিক একটা প্রতিকার বিজ্ঞ আদালত থেকে পান । অন্যথায় দেওয়ানি বিচার ব্যবস্থার প্রতি যেমন সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট দেখা দেবে তেমনি ফৌজদারী কার্য্যবিধির ১৪৫ ধারার অপপ্রয়োগও বাড়বে। স্বার্থান্বেসী শক্তিমানরা উপযুক্ত আইনের অধীন গঠিত বিজ্ঞ আদালতকে এড়িয়ে নানান ছদ্মাবরণে আদালতের বাইরে বিচার বসানোর অপচেষ্টা চালাবে।
লেখক: সৈয়দ আবুল কাসেম