প্রিয় সংবাদ ডেস্ক:: ৮ ফেব্রুয়ারি রায়ের পর আদালতে খালেদা জিয়াআবারও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে গঠনমূলক উদ্যোগে ব্যস্ত হয়েছে বিএনপি। মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) দলটির ৩ জন এবং বুধবার (২ অক্টোবর) চার জন সংসদ সদস্য দলের প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছেন। দুই দফায় সাক্ষাৎশেষে বিএনপির এমপিরা দিয়েছেন দুই রকম বক্তব্য। তাদের বক্তব্য নিয়ে ইতোমধ্যে দলে শুরু হয়েছে নানা ধরনের আলোচনা। বাংলা ট্রিবিউন
বিএনপির স্থায়ী কমিটি, চেয়ারপারসন কার্যালয়ের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই দফায় বিএনপির এমপিরা দলের হাইকমান্ডের সম্মতির ভিত্তিতেই খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। যদিও খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা মনে করছেন, এমপিরা সাক্ষাৎ করে যেভাবে সরকারের প্রতি জামিনের আহ্বান জানিয়েছেন, তা দলের চেয়ারপারসনের ‘রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের’ বিপরীত। বরং তিনি নিয়মিত জামিনে মুক্তির বিষয়ে নিজের অবস্থানে অটল আছেন। জামিনের শর্ত হিসেবে ‘দেশের বাইরে চিকিৎসা নেওয়া বা প্যারোলো মুক্তি—কোনোটিতেই খালেদা জিয়ার আগ্রহ নেই। আর এ বিষয়টি সাক্ষাৎ করে আসা এমপিদের একজন জোর দিয়ে নিশ্চিত করেছেন।
জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি নিয়ে আমাদের দলে কোনও আলোচনা নেই।’ আর দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘প্যারোলের কোনও আবেদন আমরা করিনি। আমরা প্যারোলের বিষয়ে একবারের জন্যও বলিনি। এটা তো চেয়ারপারসনের এখতিয়ার।’
মঙ্গলবার খালেদা জিয়াকে দেখে এসে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘তিনি চিকিৎসার সুযোগ পেলে তো অবশ্যই বিদেশ যাবেন। আজকে তিনি জামিন পেলে কালকেই বিদেশ যাবেন। তিনি যদি আজকে জামিন পান, প্রথম অগ্রাধিকার হবে তার চিকিৎসা।’ এরপর বুধবার এমপি জিএম সিরাজ বলেছেন উল্টো কথা। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসার ব্যাপারে খালেদা জিয়ার বক্তব্য হলো, তিনি তো বাংলাদেশেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসাই পাচ্ছেন না। প্রয়োজন হলে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাবেন। সেটা তো আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। সেটা তার নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপার।’ এছাড়া, বুধবার দুপুরে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে তার মন্ত্রণালয়ে গিয়ে সাক্ষাৎ করেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হারুনুর রশীদ। সেখানেও খালেদা জিয়ার জামিনে হস্তক্ষেপ না করতে ওবায়দুল কাদেরর প্রতি আহ্বান জানান হারুনুর রশীদ।
বুধবার যে চারজন এমপি সাক্ষাৎ করেছেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে, তাদের মধ্যে ছিলেন সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। তিনি বলেন, ‘খালেদা শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে, তিনি নিজে খেতে পারেন না, নিজে নিজের পোশাক পরতে পারেন না। তিনি কারাগারে গেলেন হেঁটে, আর সেই মানুষটা এখন হাঁটতেও পারেন না।’ রুমিন ফারহানার ভাষ্য, ‘খালেদা জিয়া দেশের বাইরে যাবেন চিকিৎসা নিতে, বা প্যারোল চাইবেন, এমন কোনও বিষয় তিনি বলেননি। আসল কথা হচ্ছে, তার সুচিকিৎসা। তার চাহিদামতো সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করাই এখন সবচেয়ে বেশি দরকার।’ তবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক (হাসপাতাল) মেজর জেনারেল এ কে এম মাহবুবুল হক বলেন, ‘খালেদা জিয়া ভালো আছেন, তার অবস্থার কোনও অবনতি হয়নি।’
আর খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলছেন, ‘বিএনপির এমপিরা সরকারের একটি পক্ষকে কনভিন্স করেছে, যদি খালেদা জিয়া বিদেশে চলে যান, তাহলে সরকার বাধা দেবে না। আর এ বিষয়টি এমপিরা দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়েই মঙ্গলবার ও বুধবার বিএনপির চেয়ারপারসনকে বোঝাতে যান। কিন্তু আইনজীবীরাও এও বলছেন, খালেদা জিয়া বিদেশে যাওয়ার শর্তে জামিনে সম্মত হবেন না।
বুধবার চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়াকে দেখে আসার পর বিএনপি নেতারা
দলের আইনজীবী ও ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সরকারের পক্ষে প্যারোল ছাড়া জামিন দেওয়া সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে কোর্টে যেতে হবে। কোর্ট এখন অবকাশকালীন ছুটিতে। আদালত খোলার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সরকার কোর্টকে ইঙ্গিত দিতে পারে, যে জামিন দেওয়া হোক। কিন্তু আমি তো কতবারই বলেছি, বিষয়টি রাজনৈতিক, দেশের আদালত রাজনীতি প্রভাবিত। সেক্ষেত্রে সরকারের সম্মতি ছাড়া কীভাবে মুক্তি মিলবে? খালেদা জিয়াকে তো রাজনৈতিক কারণেই গ্রেফতার রাখা হয়েছে। এখন বাকি থাকে প্যারোল, সরকার তো জামিন দিতে পারবে না।’
খালেদা জিয়াকে দলীয় এমপিদের দেখতে যাওয়ার বিষয়টি দলে আলোচনা হয়নি জানিয়ে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘জামিনে মুক্তি পেলেও যদি বিদেশে খালেদা জিয়া যেতে হয় চিকিৎসার জন্য, সেক্ষেত্রেও তো সরকারের পারমিশন লাগবে। সর্বাবস্থায় সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হবে।’
খালেদা জিয়ার ৩৩টি মামলার মধ্যে দুটি মামলাতে জামিন আটকে আছে। এ প্রসঙ্গে তার আইনজীবী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নাল আবদীন বলেন, ‘দুটি মামলায় জামিন হয়নি। কোর্ট ওপেন হলে আবারও আমরা জামিনের আবেদন করবো।’
খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বিএনপির প্রধানের সঙ্গে যতদূর কাজ করেছি, তিনি কোনও শর্তে জামিন নেওয়ার মতো রাজনৈতিক নেতা নন। তিনি এটা জানেন, জামিন তার প্রাপ্য ও আইনি অধিকার। আমি বিশ্বাস করি, খালেদা জিয়া নিয়মিত জামিনেই মুক্তি পাওয়ায় বিশ্বাস করেন।’
বিএনপির কোনও-কোনও নেতার পর্যবেক্ষণ, সরকারের কাছে এই আবেদনে সরকার কোনও কর্ণপাত করবে না। বুধবার খালেদা জিয়াকে দেখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হাসপাতালে যাওয়ার আহ্বান জানান বগুড়ার এমপি জিএম সিরাজ। এ বিষয়টিকেও বাঁকাভাবে নিয়েছেন কয়েকজন নেতা। স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যের প্রশ্ন, তাহলে ২০১৫ সালে আরাফাত রহমান কোকো মারা যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখতে গেলে তখন কার্যালয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি কেন?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘হ্যাঁ, মানবিক কারণে আমাদের এমপিরা বলতেই পারেন। আমরা কার কাছে বলবো? সরকার আছে, সরকারই তো জামিন আটকে রেখেছে।’
চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের একটি সূত্র বলছে, এমপিরা দুই ধরনের কথা বললেও তা একান্ত তাদের আবেগের বিষয় হতে পারে। দলীয় প্রধানের শারীরিক অবস্থা তাদের বিচলিত করেছে।
বিএনপির একটি দায়িত্বশীল পক্ষ জানিয়েছে, চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে যেভাবেই হোক তার মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে চায় দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। রাজনৈতিকভাবে সরকার বেকায়দায় আছে। পাশাপাশি খালেদা জিয়ার বিষয়ে জনমত সরকারের বিরুদ্ধে, বলে মনে করে এই পক্ষটি।
সূত্রের দাবি, সরকার আদালতে হস্থক্ষেপ করে, তা দৃশ্যমান। সর্বশেষ আদালত জামিন আবেদন বাতিল করে। ফলে, দলীয় প্রধানের চিকিৎসা ও জামিনের বিষয়ে যত নিয়মিতান্ত্রিক ও গঠনতান্ত্রিক পথ ও পদ্ধতি আছে। এর সবেই ব্যবহার করবে বিএনপি।
দলের এই সূত্রটির ভাষ্য, সব প্রক্রিয়ায়ই খালেদা জিয়ার সম্মতি নেওয়া হচ্ছে। তার সম্মতি নিয়েই চিকিৎসার বিষয়টি নিশ্চিত করার সবরকম চেষ্টা করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবেই হারুনুর রশীদ বুধবার আওয়ামী লীগের সেক্রেটারির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। খালেদা জিয়ার একজন আইনজীবীর ধারণা, আদালতে অ্যাটর্নী জেনারেলের পক্ষ থেকে জামিনের বিষয়ে যেন বাধা না দেওয়া হয়, সে দিক বিবেচনায় নিয়েই ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এমপি হারুন।
দলের দায়িত্বশীল একটি পক্ষের পর্যবেক্ষণ, খালেদা জিয়ার বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি স্বয়ং তাকেও আশ্বস্ত করার কাজটি করতে হচ্ছে বিএনপিকে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘দেয়ালে আমাদের পিঠ ঠেকে গেছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতিও স্বাভাবিক নয়। আমরা খালেদা জিয়ার জামিন চাই। তিনি অসুস্থ। সরকার তার জামিন আটকে রেখেছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে আমীর খসরু বলেন, ‘আমরা তো যুদ্ধ করবো না। আমরা নিয়মতান্ত্রিক, গঠনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দলের চেয়ারপারসনের বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। সারাদেশে সমাবেশ হচ্ছে, আরও হবে, প্রতিদিন মানববন্ধন হচ্ছে। এটাই তো রাজনৈতিক চাপ। খালেদা জিয়ার কারাজীবন সরকার দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করলে রাজনৈতিক কর্মসূচি আরও বাড়বে।’
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের সাজা দেন আদালত। এরপরে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ বাতিল চেয়ে করা আপিলে সাজা ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর করেন উচ্চ আদালত। বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা চলছে। দুর্নীতির মামলায় কারাবন্দি খালেদা জিয়াকে গত ১ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়।