চসিক’র ২ হাজার ৪শ’ ৮৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা

মো.মুক্তার হোসেন বাবু : চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এর ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ২ হাজার ৪শ’৮৫ কোটি ৯১ লাখ ৭৮ হাজার টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এটি চসিকের পঞ্চম নির্বাচিত পরিষদের শেষ (পঞ্চম) বাজেট। একই সাথে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চসিকের সংশোধিত বাজেট ২ হাজার ৪৫ কোটি ৫১ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকাও পেশ করা হয়েছে। নগরবাসীর আশা-আকাঙ্খাকার প্রতিফলন ঘটানোর প্রত্যাশা ও পরিবেশ, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বাসযোগ্য নগর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ বাজেট এমনটি বলেছেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। গতকাল মঙ্গলবার থিয়েটার ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম (টিআইসি) মিলনায়তনে বাজেট উপস্থাপনকালে এ কথা বলেন তিনি। বাজেট ঘোষণায় মেয়র বিগত সময়ের সার্বিক উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরেন। চট্টগ্রাম নগরবাসীর সহযোগিতা পেলে এবারের বাজেট বাস্তবধর্মী ও বাস্তবায়নযোগ্য হবে বলে মন্তব্য করেন মেয়র। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের উপর নগরের নাগরিক সেবা ও উন্নয়নের গুরুদায়িত্ব অর্পন করেছেন নগরবাসী। সে গুরুদায়িত্ব স্মরণ রেখে নগরবাসীর আশা-আকাক্সক্ষর প্রতিফলন ঘটানোর প্রত্যাশা নিয়ে ও চট্টগ্রাম মহানগরকে পরিবেশগত, প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, নান্দনিক ও বাসযোগ্য নগর প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন সিটি মেয়র। পরে তিনি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ২০১৯-১৯ অর্থবছরের এবং সংশোধিত বাজেট ও ২০১৯-২০ অর্থবছরের ২ হাজার ৪ শত ৮৫ কোটি ৯১ লক্ষ ৭৮ টাকার প্রস্তাবিত বাজেট নগরবাসীর নিকট উপস্থাপন করেন।
জানা গেছে, এবারের বাজেটে উন্নয়ন অনুদান ও কর আদায়কে উলে­খযোগ্য আয়খাত হিসেবে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। গত অর্থ বছরের উন্নয়ন অনুদান লক্ষ্য ১৬৮০ কোটি টাকার বিপরীতে সংস্থাটি ১ হাজার ৫৫৫ কোটি ৮৮ লাখ ১৪ হাজার টাকা উন্নয়ন সহযোগিতা পায়। সেই প্রত্যাশায় এবার ১ হাজার ৭০২ কোটি টাকা উন্নয়ন অনুদান প্রাপ্তির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
গতকাল বাজেট ঘোষণাকালে মেয়র বলেন, ২০১৮-১৯ সালে ১ হাজার ৩৬৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে বহদ্দারহাট বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত খাল খননের জন্য ৮৫১ কোটি ২৫ লাখ টাকা জেলা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য। বন্যা ও জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫৯ কিলোমিটার সড়ক, ২ দশমিক ২০ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল, ১৪ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ, ৪টি ব্রিজ ও ২টি কালভার্ট নির্মাণের কাজ চলমান আছে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৪৯ কি.মি সড়ক, ৩ দশমিক ০৫ কিমি ড্রেন, ২টি কালভার্ট, স্কেলেটরসহ একটি ফুট ওভার ব্রিজ নির্মাণ ও সাড়ে ৩০ কিমি দীর্ঘ একটি গার্ডার ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। একনেকে ১ হাজার ২২৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকায় সড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়ন ও বাস-ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ১৩০ কোটি টাকা জেলা প্রশাসককে দেওয়া হয়েছে। একনেক কর্তৃক ২৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে পরিচ্ছন্নকর্মী নিবাস নির্মাণের জন্য ১৪ তলা ৭টি ভবনের পরামর্শক নিয়োগ সম্পন্ন করে ড্রয়িং ডিজাইনের কাজ চলমান রয়েছে।
মেয়র চসিক চাকরি বিধিমালা না থাকা বড় বাধা ছিল উল্লেখ করে বলেন, চাকরি বিধিমালা ২০১৯ অনুমোদন চসিকের বর্তমান পরিষদের তাৎপর্যপূর্ণ অর্জন। এ কারণে চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের প্রতি অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা কথা জানালেন তিনি।
চসিকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহার সভাপতিত্বে মেয়র জানান, জাইকার সিজিপি প্রকল্পের আওতায় ব্যাচ-১ এ ২০ কোটি টাকায় সড়ক, সেতু, রিটেইনিং ওয়াল নির্মিত হয়েছে। ব্যাচ-২ এ ৩৪২ কোটি টাকায় সড়ক, নর্দমা, ব্রিজ, সেতু, রিটেইনিং ওয়াল, স্কুল ভবন তৈরির কাজ চলমান আছে। সংশোধিত প্রকল্পের অধীন ৩৭৫ কোটি টাকায় আরও ২২টি সড়কের বাতিসহ উন্নয়ন কাজ ২০২০ সালের জানুয়ারিতে শেষ করা হবে। বাজেট অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন প্যানেল মেয়র চৌধুরী হাসান মাহমুদ, প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ, চসিক কাউন্সিলর, সংরক্ষিত কাউন্সিলর, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট শ্রেণী পেশাজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
মেয়র বলেন, মহানগরীর ৪টি ওয়ার্ডের ১০ কিমি করে ৪৬৬ দশমিক ৭৪ কি.মি সড়কে ২৬০ কোটি ৯০ কোটি টাকা ভারতীয় লোন ও সরকারি অর্থায়নে ২০ হাজার ৬০০টি এলইডি বাতির প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী একনেকে অনুমোদন দিয়েছেন।
মেয়র আরো বলেন, আধুনিক নগর ভবন নির্মাণ প্রকল্পের ডিপিপি আগামী সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ের সভায় উপস্থাপিত হবে। আশা করছি চলতি বছর এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। বিমানবন্দর সড়কের উন্নয়নে চার লেন বিশিষ্টকরণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। দ্রæত সময়ের মধ্যে মন্ত্রনালয়ে তা জমা দেয়ার প্রক্রিয়া চুড়ান্ত করা হয়েছে। আমার শেষ বাজেটে এয়ারপোর্ট রোডের সম্প্রসারণ, বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন, কন্টেইনার ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ ও আধুনিক নগর ভবন নির্মাণসহ ১৭টি প্রকল্পের কাজ পর্যায়ক্রমে করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়াও চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়ামকে আধুনিকায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। আমাদের পঞ্চম নির্বাচিত পরিষদের নেতৃত্বে এই নগরে যে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে বিগত ২০ বছরে তা হয়নি। ২৭ বছরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কোন অর্গানোগ্রাম অনুমোদন করা যায়নি। আমি দীর্ঘ ২৭ বছর পর তা অনুমোদন করিয়েছি। আগামীতে আর একটি নতুন অর্গানোগ্রাম অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে। ঘোষিত এ বাজেট বাস্তবায়নে মেয়র নগরবাসী সহযোগিতা কামনা করেছেন।
প্রসঙ্গত, এ বছরই প্রথম প্রস্তাবিত বাজেট ২ হগাজার ৪শ’ ২৫ কোটি ৪২ লক্ষ এবং সংশোধিত বাজেট ২ হাজার ৪৫ কোটি ৫১ লক্ষ টাকা । অথচ ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ২ হাজার ৩শ’ ২৭ কোটি ৬৭ লক্ষ এবং সংশোধিত বাজেট ছিল ৮শ’ ৮৩ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা।
তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব বিভাগ একটি বৃহৎ বিভাগে রূপান্তরিত হয়েছে। নগরীর সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে হোল্ডিং কর, ট্রেড লাইসেন্স ফি, ভূমি হস্তান্তর কর, রিকশা লাইসেন্স ফি সহ অন্যান্য খাত হতেও ফি আদায় করছে সিটি করপোরেশন। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজস্বখাতে ১৬ কোটি ২১ লক্ষ টাকা বেশি আদায় হয়েছে বলে মেয়র অবহিত করেন। তিনি জানান সিটি কর্পোরেশনের আবশ্যিক সেবা কার্যক্রম হচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, রাস্তাঘাট সংস্কার ও মেরামতের মাধ্যমে চলাচল উপযোগী রাখা এবং সড়কবাতির মাধ্যমে আলোকায়নের ব্যবস্থা করা।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর বাইরেও শিক্ষাখাতে ব্যাপক কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে বলে মেয়র উল্লেখ করেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন শিক্ষাখাতে প্রতিবছর ৩৬ কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্যখাতে ১৩ কোটি টাকাসহ ৪৯ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করে যার নজির বাংলাদেশের কোনো সিটি কর্পোরেশনের নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন। সিটি কর্পোরেশনের আওতায় একটি বিশ^বিদ্যালয়, ২টি কলেজে অনার্স কোর্স চালুসহ মোট ৮টি ডিগ্রি কলেজ, ১৫টি উচ্চমাধ্যমিক কলেজ, ৪৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৭টি কিন্ডারগার্টেন, ২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি কম্পিউটার ইন্সটিটিউট, ১টি থিয়েটার ইন্সটিটিউট, ১টি কারিগরি ইন্সটিটিউট, ৩৫০ ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, ৮টি জামে মসজিদ, ২টি এবাদত খানা, ৪টি সংস্কৃত টোলসহ বিশেষ ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এসময় তিনি চট্টগ্রামের চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ড তুলে ধরে বলেন, চট্টগ্রামেই হচ্ছে এশিয়ার বৃহত্তম আধুনিক কসাইখানা। নগরীর চান্দগাঁও পুরাতন থানা এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের ৮৮ শতাংশ জায়গার উপর এ কসাইখানা নির্মিত হবে। অত্যাধুনিক এ কসাইখানা নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ৮৩ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পশু জবাই ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ রক্ষায় দেশের অন্যান্য মেগা সিটির চেয়ে একধাপ এগিয়ে যাবে চট্টগ্রাম মহানগর বলে মন্তব্য করেন সিটি মেয়র।

সর্বশেষ