spot_imgspot_img
spot_imgspot_img

তাসফিয়া, আদনান এবং সমাজ

spot_img

 

- Advertisement -

তুষার আবদুল্লাহ : চট্টগ্রামে যাওয়া হয়েছিল মাস চারেক আগে। ছুটির দিন বিকেলে আড্ডা জমে উঠেছিল চট্টলার বন্ধু ও সহকর্মীদের সঙ্গে। পেশাগত আলাপের সঙ্গে আড্ডার প্রতিপাদ্য হয়ে উঠেছিল বন্দর নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। আড্ডা উদ্বিগ্ন হয় মাদক বাণিজ্য ও সেবনের প্রকাশ্য হাট দেখে। ওই বিকেলের আড্ডায় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কয়েকজন বড় কর্তাও যোগ দিয়েছিলেন। তারা আমাদের উদ্বেগের মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন এই তথ্য জানিয়ে- স্বয়ং চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ আতঙ্কিত সেখানকার স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে। আরেকটু প্রসারিত করে বলা যায় উঠতি তরুণদের নিয়ে। পুলিশ কর্তারা বলছিলেন, সবচেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে নগরীর কিশোর-কিশোরীরা। তারা যেমন ইংরেজি মাধ্যম পড়ুয়া, তেমনি বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীও আছে। এদের সামনে থাকা কিশোর-কিশোরীরা নগরীর উচ্চবিত্ত শ্রেণির সন্তান। ধনকুবেরদের সন্তানেরা মাদকসহ নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে ক্ষমতা প্রদর্শন করতে গিয়ে তারা প্রতিপক্ষ, কখনও নিজ বন্ধুকেও হত্যা করছে। মাদক ব্যবসা এবং প্রেমজনিত কারণে হত্যার ঘটনা ঘটছে বেশি। এই বয়সীদের আবার প্রশ্রয় দিচ্ছে রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত তরুণরা, তাদের ভাষায় ‘বড় ভাই’রা। স্কুল পড়ুয়া এই শিক্ষার্থীরা কাউকেই পরোয়া করছে না। কাউকে কাউকে আটক করলে তাদের ধনবান অভিভাবকরা এসে ধমক দিয়ে বা আপসের মাধ্যমে ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এই কিশোর-তরুণদেরই নগরীর রাজপথ চিড়ে বিকট শব্দে মোটরযান নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। তাদের আস্ফালন চোখে পড়ে নগরীর আলো ঝলমল রেস্টুরেন্টে।

সম্প্রতি সানশাইন গ্রামার স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী তাসফিয়া হত্যা ঘটনায় মনে পড়লো পুলিশ কর্মকর্তাদের সেই উদ্বেগের কথা। সেদিনের সেই আড্ডায় ভয় ও উৎকণ্ঠা এসে ভর করেছিল আমরা যারা সন্তানের অভিভাবক তাদের সবার কাঁধে।
ঢাকায় আমরা উত্তরার কথা জানি। সেখানে কিশোর বয়সীদের একাধিক গোত্র আছে। এক দল, অপর দলের এলাকা দখলের জন্য রণসজ্জায় নেমে পড়ে পথে। এরাও উচ্চবিত্তের সন্তান। তবে বলে রাখা ভালো, সকল এলাকাতেই উচ্চবিত্তের সন্তানেরা টাকার বিনিময়ে নিম্নমধ্যবিত্ত বা বিত্তহীন পরিবারের ছেলেমেয়েদের দখলে রাখে। তাদের মাধ্যমেই মাদক কেনাবেচা হয়। অস্ত্রের জোগান আসে। কাউকে হত্যার জন্য ওই শ্রেণির সন্তানদের ব্যবহার করা হয়। যেন উচ্চবিত্ত রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরেই। শুধু উত্তরার কথা বলছি কেন, ধানমন্ডি, গুলশান, মীরপুর, ডিওএইচএস, বনশ্রী, বাড্ডা, পুরাতন ঢাকা- কোথায় ওদের এখন দেখা যায় না? এই বয়সী কিশোর তরুণদের উদ্ধত আচরণে কোণঠাসা সবাই। প্রকাশ্যে উদ্ধত আচরণ করে যাওয়ার পরও কেউ বাধা দেওয়ার সাহস দেখাতে পারছে না। দুই-একজন এগিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের প্রাণ দেওয়ার কথাও সবার জানা। পুলিশ প্রশাসনও যেন অসহায়। কারণ এদের পেছনে বিত্ত, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব অসীম। ফলে এই অসীম অসুরদের সামনে সাহস করে দাঁড়াতে পারছে না কেউ।

গ্রীষ্মের ফুলের টানে ইদানিং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাওয়া হচ্ছে। বিকেলের দিকে যেদিন যাই, সেদিন ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। গর্জন করে মোটর সাইকেল ও গাড়ির যাওয়া আসা বুক কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। বাহনের গর্জনের সঙ্গে আছে আরোহীদের বিভৎস চিৎকার। বাহন ছাড়াও যারা পথ চলছে তারাও এই বিভৎস উৎসবের বাইরে নয়। বয়সে সবাই বড় জোর কলেজ পড়ুয়া। অনেকের শিক্ষার সঙ্গে কোনও যোগাযোগই নেই। এদের কেউই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়। আশপাশের আবাসিক এলাকার। কিন্তু দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পরিবেশ দূষণ করে যাচ্ছে তারা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থীরা কী করে, কেন এই তাণ্ডব সয়ে যাচ্ছে? কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন করেও সদুত্তোর পাইনি।

তাসফিয়ার আগেও অনেক নাম এসেছে। আমরা অনেক সন্তানকে হারিয়েছি। হারানোর জন্য সন্তানদের দায় যতো, তারচেয়ে বেশি দায় আমাদেরই, অভিভাবকদের। সন্তানের বন্ধু হচ্ছে কে, কারা? মুঠোফোনে, ইন্টারনেটে সন্তান কার সঙ্গে, কী নিয়ে ব্যস্ত থাকছে তা আমরা খেয়াল রাখছি কতটুকু? আমাদের সম্পদ, প্রতিপত্তি প্রকাশের বাহন বা মাধ্যম হিসেবে কি সন্তানদের ব্যবহার করছি? ব্যবহার করতে গিয়ে কিংবা ছাড় দিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আর তাদের আয়ত্ত্বে রাখতে পারছি না। নিজ সন্তানদের কাছেই জিম্মি হয়ে পড়ছি। ভুল পথে গিয়ে সন্তানরা অপরাধী হয়ে উঠছে, যার পরিণামে তাদের গন্তব্য হচ্ছে মৃত্যু। তাসফিয়ার মৃত্যু রহস্যের পুরোটা এখনও উন্মোচিত হয়নি। আদনান কতটা জড়িত তাও চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়নি। তবে নবম শ্রেণির একটি মেয়ের ফেসবুক প্রেম, বন্ধুর সঙ্গে রেস্টুরেন্টে গিয়ে সময় কাটানো এবং আদনানের অস্ত্র মামলার আসামির সঙ্গে বন্ধুত্ব, কোনোটাই শিক্ষার্থী ও কৈশোর সুলভ নয়। এখানে এলোমেলো, অগোছালো ও অনিয়ন্ত্রিত কৈশোর এবং দায়িত্বহীন অভিভাবকত্বের ছায়া স্পষ্ট। তাই তাসফিয়ার মৃত্যু এবং আদনানকে ঘিরে থাকা সন্দেহের বলয়-কোনোটির দায় থেকেই সমাজের মুক্তি নেই।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি

(বাংলা ট্রিবিউন থেকে নেওয়া)

spot_imgspot_img
spot_imgspot_img

সর্বশেষ