spot_imgspot_img
spot_imgspot_img

সাবেক ওসি’র স্ত্রী চুমকি কারণের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

spot_img

মো.মামুন :: প্রায় চার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা ‘হত্যাকান্ডে’ সাময়িক বরখাস্ত হওয়া কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ এবং তার স্ত্রী চুমকি কারণের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল রোববার দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারি পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বাদী হয়ে মামলাটি (নং-১১) দায়ের করেছেন। ঘটনাস্থল বিবেচনায় মামলাটি করা হয়েছে দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১ এ।
অভিযুক্ত প্রদীপ কুমার দাশ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের উত্তর সারোয়াতলী গ্রামের মৃত হরেন্দ্র লাল দাশের ছেলে। নগরীর কোতোয়ালী থানার পাথরঘাটা আর সি চার্চ রোডে তাদের নিজস্ব একটি আবাসিক ভবন আছে। সেই ভবনে তার স্ত্রী চুমকি কারণ সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, প্রায় চার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মধ্যে ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৬৩৫ টাকা ‘ওসি প্রদীপ’ ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেছেন বলে দুদক অভিযোগ এনেছে। আরও ১৩ লাখ ১৩ হাজার ১৭৫ টাকার সম্পদের তথ্য বিবরণীতে গোপন করার অভিযোগও আনা হয়েছে চুমকির বিরুদ্ধে। প্রদীপ ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করে স্ত্রীর নামে হন্তান্তর ও স্থানান্তর করেছেন বলেও দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদন এবং এজাহারে বলা হয়েছে।
মামলার এজাহারে চুমকি কারণকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তিনি স্বামী ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অপরাধলব্ধ অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তরপূর্বক একে অপরের সহযোগিতায় ভোগদখলে রেখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। মামলায় আসামি চুমকি ও প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে দুদক আইন, ২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭ (১), মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ (২) ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা এবং দন্ডবিধির ১০৯ ধারায় অভিযোগ এনেছেন বাদী।
দুদক সূত্রে আরো জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-২ থেকে চুমকি কারণের কাছে সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার নোটিশ পাঠানো হয়। ১২ মে তিনি সম্পদ বিবরণী দুদকে জমা দেন। এতে তিনি ৩ কোটি ৬৬ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা স্থাবর এবং ৪২ লাখ ৮৪ হাজার ৩৯৪ টাকার অস্থাবরসহ মোট ৪ কোটি ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৬৯৪ টাকার সম্পদের তথ্য উল্লেখ করেন। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে চুমকি কারণের নামে ৩ কোটি ৬৬ লাখ ২৪ হাজার ৪৭৫ টাকার স্থাবর এবং ৫৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৯৪ টাকার অস্থাবরসহ মোট ৪ কোটি ২২ লাখ ৪৮ হাজার ৮৬৯ টাকার সম্পদের হিসাব উঠে আসে। এ হিসেবে এজাহারে ১৩ লাখ ১৩ হাজার ১৭৫ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়েছে। সম্পদ বিবরণীতে চুমকি কারণ তার বাবার কাছ থেকে দান হিসেবে পাওয়া জমিসহ একটি ছয়তলা বাড়ির তথ্য দেন। দুদক অনুসন্ধানে পেয়েছে, চুমকির কারণের বাবা সাবরেজিস্ট্রি দলিলমূলে তাকে বাড়ি দিলে তার অপর দুই ভাই ও এক বোনকে কোনো বাড়ি দেননি। অথচ দুই ছেলের নামে উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পদও নেই। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওসি প্রদীপ তার ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অপরাধলব্ধ অর্থ গোপন করার অসৎ উদ্দেশে স্থানান্তর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে তার শ্বশুরের নামে বাড়ি নির্মাণ করে পরবর্তীতে তার স্ত্রী চুমকি কারণের নামে দান করিয়ে নিয়ে ভোগদখল করছেন।
দুদক তাদের সংগ্রহ করা বিভিন্ন নথি পর্যালোচনা করে জানতে পেরেছে, চুমকি কারণ একজন গৃহিণী। তিনি কমিশন ব্যবসায়ী হিসেবে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রথম আয়কর রিটার্ন প্রদান করেন। পরবর্তীতে তিনি মাছের ব্যবসা ও বাড়ি ভাড়া থেকে আয় দেখিয়ে রিটার্ন দাখিল করে আসছেন। ২০১৩-১৪ বছরে তিনি ১১ লাখ ২০ হাজার টাকা ও পরবর্তী অর্থবছরে তিনি ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা মূলধন দেখিয়েছেন। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে কমিশন ব্যবসার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। চুমকি কারণ কমিশন ব্যবসার লাইসেন্স, ব্যাংকে লেনদেনের কোনো প্রমাণ এবং সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে ব্যবসা করার জন্য যথাযথ অনুমোদন দেখাতে পারেননি।
জানা গেছে, সম্পদ বিবরণীতে চুমকি কারণ মাছের ব্যবসা থেকে দেড় কোটি টাকা আয় দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি ২০০২ সালে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের উত্তর সারোয়াতলী গ্রামে পাঁচটি পুকুর ইজারা বরাদ্দ নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু দুদক অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে, চুমকি কারণ একজন গৃহিণী এবং তার স্বামী প্রদীপ কুমার দাশ ১৯৯৫ সালে পুলিশের উপ-পরিদর্শক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। ২০০২ সালে তাদের ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা সঞ্চিত অর্থ ছিল না। ২০০২ সাল থেকে মাছের ব্যবসা থেকে আয় করার কথা বলা হলেও আয়কর রিটার্নে তিনি সেটা উলে­খ করেননি। এতে দুদকের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, মাছের ব্যবসা থেকে দেড় কোটি টাকা আয়ের বিষয়টি সঠিক নয়। চুমকি কারণ তার স্বামী প্রদীপের অপরাধলব্ধ অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তরের উদ্দেশে ভূয়া মাছের ব্যবসা দেখিয়েছেন।
এদিকে সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং তার স্ত্রী চুমকি কারণের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়া মামলা দায়ের করা হয়েছে উল্লেখ করে দুদক কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন বলেন, মামলার এজাহারে আমরা উল্লেখ করেছি চুমকি কারণ দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ১৩ লাখ ১৩ হাজার ১৭৫ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। এছাড়া তিন কোটি ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৬৩৫ টাকার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হয়েছে, যা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করে পরস্পরের যোগসাজশের মাধ্যমে হস্তান্তর ও স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে ভোগদখল করছেন।
সম্পদ বিবরণী এবং সংগ্রহ করা নথিপত্র পর্যালোচনায় দুদক আরও পেয়েছে, চুমকি কারণ মোট ৪ কোটি ২২ লাখ ৪৮ হাজার ৮৬৯ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। একই সময়ে তিনি ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পারিবারিক ব্যয়সহ অন্যান্য ব্যয় করেছেন। এ হিসেবে তার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে, ৪ কোটি ৪৪ লাখ ১৮ হাজার ৮৬৯ টাকা। দুদক তার বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয় পেয়েছে ৪৯ লাখ ১৩ হাজার ২৩৪ টাকা। এক্ষেত্রে তার জ্ঞাত আয়ের উৎসবর্হিভূত সম্পদের পরিমাণ হচ্ছে ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৬৩৫ টাকা।
দুদক কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন আরো বলেন, চুমকি কারণের কাছে যখন সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল, একইসঙ্গে প্রদীপ কুমার দাশকেও দেওয়া হয়েছিল। প্রদীপও সম্পদ বিবরণী জমা দিয়েছেন। সেই বিবরণী যাচাই-বাছাই চলছে। এ মামলা শুধু চুমকির সম্পদ বিবরণীর ভিত্তিতে করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। ওই ঘটনায় সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস গত ৫ অগাস্ট কক্সবাজারের হাকিম আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেন, সেখানে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকতসহ নয়জনকে আসামি করা হয়। মামলাটি তদন্ত করছে র‌্যাব। আদালতে আত্মসমর্পণ করার পর প্রদীপকে চাকরি থেকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

spot_imgspot_img
spot_imgspot_img

সর্বশেষ