ওসি প্রদীপের ২০ বছরের কারাদণ্ড

সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকি কারণের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে। রায়ে প্রদীপকে পৃথক ধারা মিলিয়ে মোট ২০ বছর এবং চুমকিকে ২১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আদালত উভয় আসামিকে চার কোটি টাকা করে অর্থদণ্ডও দিয়েছেন। একই রায়ে আদালত তাদের সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তেরও নির্দেশ দিয়েছেন।

- Advertisement -

বুধবার (২৭ জুলাই) চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ মুন্সী আবদুল মজিদ এ রায় ঘোষণা করেছেন।

দুদকের আইনজীবী মাহমুদুল হক সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, আদালত সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ ও দুদকের দাখিল করা নথিপত্র পর্যালোচনা করে প্রদীপ ও চুমকিকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছেন। প্রদীপ কুমার দাশ একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করে সেই সম্পদ স্ত্রীর অনুকূলে স্থানান্তরপূর্বক মানিলন্ডারিংয়ের অপরাধ সংঘটিত করেছেন

রায়ে আদালত মানিলন্ডারিং আইনের ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারায় প্রদীপ ও চুমকিকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড, ৪ কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় উভয় আসামিকে ২ বছর করে কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭ (১) ধারায় উভয় আসামিকে ৮ বছর করে কারাদণ্ড, ১০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন। একই আইনের ২৬ (১) ধারায় চুমকিকে এক বছরের কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন। তবে ২৬ (১) ধারায় আসামি প্রদীপ কুমার দাশ খালাস পেয়েছেন। দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায়ও উভয় আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

আদালত বিভিন্ন ধারায় দেওয়া সাজা একইসঙ্গে কার্যকর হবে বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন।

আইনজীবী মাহমুদুল হক বলেন, ‘আমরা আসামিদের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছি। আদালত যে রায় দিয়েছেন, তাতে আমরা সন্তুষ্ট। এ রায় দুর্নীতির বিচারের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে আমরা মনে করি।’

এদিন সকাল পৌনে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রদীপকে আদালতে নেওয়া হয়। গাড়ি থেকে নামার পর থেকে তিনতলায় আদালত কক্ষে নিয়ে যাওয়ার সময় পর্যন্ত প্রদীপকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, ‘আমি নির্দোষ, আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি নিজের স্বার্থে কিছুই করিনি, যা করেছি রাষ্ট্রের স্বার্থে।’

প্রদীপের আগেই তার স্ত্রী চুমকি কারণকে পুলিশ প্রহরায় আদালতে নেওয়া হয়। রায় ঘোষণার পর কারাগারে নেওয়ার সময় চুমকি কারণ সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট নয়। আমার স্বামী ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ভালো কাজ করেছে বিধায় বিভিন্ন মহল তার বিরুদ্ধে লেগেছিল। তারা ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে আমাদের পরিবারকে ধ্বংস করেছে।’

প্রদীপ কুমার দাশ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের উত্তর সারোয়াতলী গ্রামের মৃত হরেন্দ্র লাল দাশের ছেলে। নগরীর কোতোয়ালী থানার পাথরঘাটা আর সি চার্চ রোডে তাদের নিজস্ব একটি আবাসিক ভবন আছে। সেই ভবনে তার স্ত্রী চুমকি কারণ ও সন্তানদের নিয়ে তিনি বসবাস করতেন।

প্রদীপ কুমার দাশ সর্বশেষ কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এরপর টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ওই বছরের ৬ আগস্ট থেকে কারাগারে আছেন প্রদীপ কুমার দাশ। ওই মামলায় চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি দেয়া রায়ে প্রদীপকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত।

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা হত্যা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড়ের মধ্যে ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট প্রদীপ ও চুমকি কারণের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের একটি মামলা দায়ের হয়। দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারি পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বাদি হয়ে দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১ এ মামলাটি দায়ের করেছিলেন।

মামলায় প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকি কারণের বিরুদ্ধে প্রায় চার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৬৩৫ টাকা ‘ওসি প্রদীপ’ ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেছেন বলে দুদক অভিযোগ করে। আরও ১৩ লাখ ১৩ হাজার ১৭৫ টাকার সম্পদের তথ্য বিবরণীতে গোপন করার অভিযোগও আনা হয়।

তদন্তের পর ২০২১ সালের ২৬ জুলাই দুদক কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন আদালতে দু’জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। দুদক আইন, ২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭ (১), মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

অভিযোগপত্রে প্রদীপের বিরুদ্ধে ২ কোটি ৩৫ লক্ষ ৯৮ হাজার ৪১৭ টাকার জ্ঞাত আয়বর্হিভূত সম্পদ অর্জন করে সেই সম্পদ স্ত্রীর নামে হস্তান্তর ও স্থানান্তরপূর্বক মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগের তথ্যপ্রমাণ উল্লেখ করা হয়। এছাড়া উভয়ের বিরুদ্ধে ৪৯ লক্ষ ৫৮ হাজার ৯৫৭ টাকার অর্জিত সম্পদের তথ্য গোপন ও মিথ্যা তথ্য সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখের তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার কথা উল্লেখ করে দুদক।

অভিযোগপত্রে চুমকি কারণের নামে নগরীর কোতোয়ালী থানার পাথরঘাটায় ২ কোটি ১৭ লাখ ২৬ হাজার ৭০০ টাকা দামের ছয়তলা বাড়ি, পাঁচলাইশ থানার পশ্চিম ষোলশহর এলাকায় এক কোটি ২৯ লাখ ৯২ হাজার ৬০০ টাকা দামের জমি এবং কক্সবাজারের ঝিলংঝা মৌজায় ১২ লাখ ৫ হাজার ১৭৫ টাকার একটি ফ্ল্যাটের বিষয় উল্লেখ আছে।

সম্পদ বিবরণীতে চুমকি কারণ নিজেকে মৎস্য ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখ করে সম্পদ অর্জনের তথ্য দিয়েছিলেন। তবে অভিযোগপত্রে মাছের ব্যবসা থেকে চুমকির আয়ের কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়।

২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর দুদকের মামলায় আসামি প্রদীপ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছিল।

গত ২৯ মে এ মামলায় মোট ২৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ৬ জুন থেকে যুক্তিতর্ক শুরু হয়। ১৮ জুলাই যুক্তিতর্ক শেষে আদালত রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন।

অবৈধ সম্পদের মামলা দায়েরের পর থেকে চুমকি কারণ আত্মগোপনে ছিলেন। গত ২৩ মে তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করার পর থেকে কারাগারে আছেন।

সারাবাংলা

সর্বশেষ