হাজারো ভক্তের ভালোবাসায় বিদায় আইয়ুব বাচ্চুর

 

- Advertisement -

মো.মুক্তার হোসেন বাবু : কিংবদন্তি ব্যান্ড সংগীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর জন্মভূমি চট্টগ্রামে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হাজারো ভক্তের ভীড় দেখা গেছে জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ মাঠে। ফুল হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রাসেল। আইয়ুব বাচ্চুকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসলেন তিনি। দীর্ঘ সারিতে এই ব্যান্ড তারকার যে ভক্ত-অনুরাগীরা ছিলেন তার একজন ২১ বছর বয়সী এই যুবক। আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর খবর রাসেল প্রথম পান সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যামে। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে বসের কনসার্টে গিয়েছিলাম। আমি ছবিও তুলছিলাম ওনার সাথে। ওনার এভাবে চলে যাওয়া আমি মানতে পারছি না। রাসেলের মতোই একগুচ্ছ গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন মুজিব মিয়া। এসেছেন নগরীর একে খান থেকে। তিনি বলেন, আইয়ুব বাচ্চু তিন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয়। আমার আম্মু উনার গান পছন্দ করে, আমি করি এবং পরিবারের সকল সদস্যরাও।
বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতাঙ্গনে গিটারের জাদুকর হিসেবে খ্যাত আইয়ুব বাচ্চু হার্ট অ্যাটাক করে গত বৃহস্পতিবার মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। এলআরবির লিড গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার ও প্লেব্যাক শিল্পী। চার দশক বাংলাদেশের তরুণদের গিটারের মূর্ছনায় মাতিয়ে রেখেছিলেন তিনি।গিটার বাদনে তার খ্যাতি ছিল পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই। তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে জামিয়াতুল ফালাহ মসজিদ মাঠে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আরও উপস্থিত আছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী এবং পরিবারের সদস্যরা।
এর আগে সকাল দশটা থেকে অপেক্ষা, সাড়ে এগারোটায় লাশ পৌছে মামার বাড়ির মাঠে। সূর্য যখন মাথার ঠিক উপরে তখন খোলা মাঠে আনা হয় প্রয়াত ব্যান্ড শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ । তিনটি লাইন ধরে রোদের তাপ মাথায় নিয়ে হাজার হাজার বাচ্চু ভক্তরা লাইনে দাড়িয়ে আছেন। শুধু একটা কারণ প্রিয় শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুকে শেষ দেখাটা দেখার জন্য।
জানা যায়, গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে দশটায় একটি ফ্লাইটে শাহ আমানত বিমান বন্দরে পৌছলে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন লাশ গ্রহণ করেন। এরপর বারোটার দিকে পূর্ব মাদারবাড়ি বালুর মাঠে লাশ নিয়ে এসে আইয়ুব বাচ্চুর মামা আবদুল হালিমের কাছে লাশ হস্তান্তর করেন। আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ মামার বাড়িতে ত্রিশ মিনিট রাখার পর সর্বস্তরের মানুষের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এসময় হাজার হাজার পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও মাঠে ভিড় করেন প্রিয় শিল্পীকে দেখার জন্য।
এক এক করে শেষ দেখা দেখছেন প্রিয় শিল্পীকে, কারো চোখে জলে টলমল, কারো চোখে বেয়ে পড়ছে জল। দক্ষিণ কাট্টলী থেকে আসা সোহেল নামের একজন বলেন, প্রিয় শিল্পীর মৃত্যুর খবর শুনে খুব খারাপ লেগেছে, যখন শুনছি চট্টগ্রামে আনা হবে তখন সিদ্ধান্ত নিলাম শেষ দেখা দেখার জন্য চলে আসব। এসে এত মানুষ দেখে আশ্চর্য হলাম। কত জনপ্রিয় হলে এত মানুষ এ কড়া রোদের মধ্যে দাড়িয়ে থাকে শেষ দেখা দেখার জন্য। বাচ্চু ভাইকে দেখে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারিনি, নিজের অজান্তে চোখের পানি চলে আসল।
কথা হয় হাটহাজারী থেকে আসা মোহসিনের সাথে, সে জানায় প্রিয় শিল্পীকে শেষ বারের মতো দেখার জন্য আসলাম। আইয়ুব বাচ্চুর স্মৃতি চারণ করে বক্তব্য রাখেন আঞ্জুমান আরা, রেখা আলম চৌধুরীর ও তার মামা আবদুল হালিম।
পূর্ব মাদারবাড়ির বালু মাঠ থেকে বিকেল তিনটার দিকে জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানো শেষে বাদ আছর নামাজে জানাযার পর চৈতন্য গলির কবরস্থানে মায়ের পাশে দাফন করা হয়।
এদিকে ব্যান্ড কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চুর নামে তার জন্মস্থান চট্টগ্রামে হবে সড়ক ও মুসলিম হলের নামকরণ। এমনটায় ঘোষণা দিলেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। এছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে হবে আইয়ুব বাচ্চু কর্ণার। যেখানে থাকবে আইয়ুব বাচ্চুর ব্যবহৃত ৬০টি গিটার ও তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি সম্ভার। এ কর্ণারের মাধ্যমে বাচ্চুকে তরুণ প্রজন্মের কাছে সুন্দর ও নান্দনিকভাবে উপস্থাপনার কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী।
গতকাল শনিবার আইয়ুব বাচ্চুর লাশ তার মামার হাতে হস্তান্তর করে সাংবাদিকদের দেওয়া সাক্ষাতকারে মেয়র বলেন, প্রয়াত ব্যান্ড শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর জন্য একটি সড়কের ও মুসলিম হলের নামকরণসহ যা যা করার দরকার সব নিজ উদ্যোগে করবো।
১৯৬২ থেকে ২০১৮। ৫৬ বছরেই বয়সে এ ব্যান্ড কিংবদন্তির সংগ্রহে ছিল ৬৭টি গিটার। এর মধ্যে ৬০টি গিটার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) দেয়ার ইচ্ছা ছিল বাচ্চুর। দেড় বছর আগে ছোট মামা আবদুল আলীমকে এ ইচ্ছের কথা জানিয়েছিল আইয়ুব বাচ্চু। তারা মামা আবদুল আলীম জানান, গিটারই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। গিটার থেকে আইয়ুব বাচ্চুর উৎপত্তি। গিটারকে ভালোবেশে জয় করেছে পুরো দুনিয়া। যখনই বাচ্চু দেশের বাইরে যেত গিটার কিনতো। এসব গিটার মাঝে একবার নিলামে তুলেছিল সে। কিন্তু আবার সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। পরে দেড় বছর আগে বাচ্চু চট্টগ্রামে আসলে আমাকে বলেছিল তার ৬০টি গিটার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে দিয়ে দিবে। যাতে সেগুলো গিটারপ্রেমী শিক্ষার্থীরা পেয়ে অনুপ্রাণিত হয়। এ বিষয়ে চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বাচ্চুর সাথে আমার আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক গভীর। প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে আলাদা নবীণবরণ অনুষ্ঠান হয়। এ বছর আমরা চিন্তা করেছিলাম, আলাদা না করে একটি সম্মিলিত নবীণ বরণ অনুষ্ঠান করবো। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠে এ অনুষ্ঠানে গান করার কথা ছিল আইয়ুব বাচ্চুর। গত মাসখানেক আগে তার সাথে দেখা হয়, তখন বিষয়টি শেয়ার করেছিলাম। সে আমায় বলেছিল, স্যার, আপনি যখনই বলেন, আমি সব প্রোগ্রাম বাদ দিয়ে চলে আসবো। আইয়ুব বাচ্চুর কর্ণার সম্পর্কে তিনি বলেন, একজন সাংবাদিক বন্ধু আমাকে জানিয়েছে বিষয়টি। তাই আমি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে একটি নান্দনিক কর্ণার করার। যদি তার গিটারগুলো পাই বা কোনো ধরনের ফরমাল প্রস্তাব পেলেই আমরা এগুতে পারবো।

সর্বশেষ