দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম আদালতের হাজতখানা। কারাগার থেকে মামলায় হাজিরা দিতে আসা বন্দিরা এখানে জড়াচ্ছে নানা অপরাধে। এমনকি কিছু পুলিশ সদস্যকে লোভে ফেলে অনৈতিক সুযোগ নিচ্ছে দুর্ধর্ষ অপরাধী ও জঙ্গি সদস্যরা।
তারা পুলিশ সদস্যদের ম্যানেজ করে মোবাইল ফোন ব্যবহারের পাশাপাশি সহযোগীদের সঙ্গে দেখা করারও সুযোগ পাচ্ছে। এমনকি আদালতের অভ্যন্তরে থাকা রেস্টুরেন্টে বসেও হাজিরা দিতে আসা বন্দিদের খাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রাম আদালত থেকে বারবার ঘটছে আসামি পলায়নের ঘটনা।
জেলা হাজতখানার এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম ঠেকাতে এবার তৎপর হয়েছে জেলা পুলিশ। জেলা হাজতখানার ভেতরে-বাইরে নজরদারি বাড়াতে লাগানো হচ্ছে ৮টি সিসি টিভি ক্যামেরা। এতে করে অফিসে বসেই হাজতখানার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন জেলা পুলিশ সুপার।
চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ এবং মহানগর দায়রা জজ ও তাদের অধীন ৭৪টি আদালত রয়েছে। মহানগর দায়রা জজ ও তার অধীন আদালত এবং জিআরও শাখায় ১৪৫ জন পুলিশ সদস্য কাজ করছেন। তাদের অধিকাংশ আদালতের প্রশাসনিক কাজে মোতায়েন রয়েছেন।
জেলা ও দায়রা জজ এবং তার অধীন জুডিশিয়াল আদালতে পুলিশ রয়েছে ১০০ জনের মতো। যাদের অধিকাংশই আদালতে প্রশাসনিক ও বিচারকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত। আদালতগুলোর বিচারক ও আসামিদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করেন সিএমপি ও জেলা পুলিশের প্রসিকিউশন শাখা।
গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম আদালত থেকে পালিয়েছে চট্টগ্রাম আন্তঃজেলা গাড়ি চোরের সর্দার একাধিক মামলার আসামি নাছির ওরফে মামুন। আদালত থেকে দুর্ধর্ষ এ চোর পালানোর ৬ মাসেও তাকে গ্রেফতার করা যায়নি।
এরমধ্যে ২ এপ্রিল হাজতখানা থেকে পালিয়ে গেছে হুমায়ুন রশীদ মামুন নামের ছয়টি মামলার এক আসামি। মামুন মিরসরাই উপজেলার বারৈয়ারহাট পৌর সদরের বাসিন্দা। আদালত থেকে পালানোর দুই ঘটনায় জেলা পুলিশ বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছে।
এ ছাড়া গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলায় প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাত করে মো. জুয়েল নামে এক ছিনতাইকারীকে আহত করেছে চার অপরাধী। ছুরিকাঘাতে আহত জুয়েল চট্টগ্রাম তৃতীয় মহানগর যুগ্ম-দায়রা জজ আদালতের এজলাসের ভেতর আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচান।
এর আগে ২৯ আগস্ট আদালত ভবনের নিচতলায় বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব কারাবন্দি আসলাম চৌধুরীর সঙ্গে সেলফি তোলা নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে ছুরিকাঘাতে তিন বিএনপি কর্মী গুরুতর আহত হয়। ২৬ জুলাই চট্টগ্রাম আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলায় দুই স্ত্রীর মারামারি থামাতে গিয়ে এক স্ত্রীকে মারধরের ঘটনায় স্বামী আবদুর রহমানকে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠান আদালত।
১০ এপ্রিল হাজতখানায় রকি নামের এক আসামি আরেক আসামি কাজলকে মেরে রক্তাক্ত করে। এছাড়া কারাগার থেকে আদালতে হাজিরা দিতে আসা বন্দিরা জড়াচ্ছে নানা অপরাধে। রাঙ্গুনিয়া উজেলার বাসিন্দা প্রবাসী ইকবাল হোসেন যুগান্তরকে জানান, তার বড় ভাই জিল্লুর রহমান ভান্ডারি হত্যা মামলায় গ্রেফতার এক আসামিকে কারাগার থেকে আদালতে হাজিরা দিতে আনা হলে বিশেষ কামরায় রাখা হয়। সেখানে পুলিশ ওই আসামিকে মাদক সেবনের সুযোগ করে দেয় বলেও তিনি শুনেছেন।
মানবাধিকার সংগঠক ও আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান যুগান্তরকে জানান, একজন বন্দিকে হাজিরা দিতে কারাগারে সকালে আনা হলে বিকালে ফেরত নেয়া হয়। এরমধ্যে কারাগার থেকে ওই বন্দিকে কোনো ধরনের খাবার-দাবার সরবরাহ করা হয় না। তাই স্বজনরাই আদালতের হাজতখানায় থাকা বন্দিদের খাবার সরবরাহ করে।
এছাড়া কোনো কোনো বন্দিদের ক্ষেত্রে কোর্ট পুলিশ বিশেষ সুবিধা দেয়ায় ঘটছে আসামি পালানোর ঘটনা। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের কোর্ট ইন্সপেক্টর এএইচএম মশিউর রহমান যুগান্তরকে জানান, ২ এপ্রিল আদালত থেকে আসামি পলায়নের ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে।
এর সঙ্গে পুলিশের কোনো গাফিলতি আছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) রেজাউল মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, আদালতের হাজতখানা থেকে আসামি পলায়ন ও নানা অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে বসানো হচ্ছে সিসিটিভি ক্যামেরা। হাজতখানার ভেতরে ও বাইরে আটটি ক্যামেরা বসানো হবে। এসব ক্যামেরার মাধ্যমে পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকেও হাজতখানার দৃশ্য দেখা যাবে।