মো.মুক্তার হোসেন বাবু:: ৮৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্কর্য ‘বজ্রকণ্ঠ’ নামকরণে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ভাস্কর্য তৈরী করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। চট্টগ্রামের হালিশহরস্থ বড়পুল মোড়ে নির্মিত হয়েছে সুবিশাল এই ভাস্কর্য। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে এটি নির্মিত হয়েছে। গতকাল বুধবার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন বঙ্গবন্ধুর এই ভাস্কর্যের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনকালে সিটি মেয়র বলেন, এই‘বজ্রকণ্ঠ’ ভাস্কর্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিরচেনা সেই ভঙ্গিতে তাঁর ‘বজ্রকণ্ঠে’ ভাষণের অভিব্যক্তিকে। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর দূরদর্শী রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় বাঙালি অর্জন করেছিল একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। বাংলাদেশ আজ যখন শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ইত্যাদিতে উন্নতির ধারাবাহিকতায় এগিয়ে চলছে তখন এলো বাংলাদেশের মহান স্থপতি, সময়ের সাহসী কণ্ঠস্বর জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী। তাঁর দৃপ্ত কণ্ঠের বজ্রধ্বনি কাঁপিয়ে দিয়েছিল সা¤্রাজ্যবাদী পাকিস্তানী শক্তির ভীত এবং ঐক্যবদ্ধ করেছিল সমগ্র বাঙালি জাতিকে। ভাষণরত বঙ্গবন্ধুর শক্তিশালী সেই হাতটিই যেন সমগ্র বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধতার প্রতীক। তিনি বলেন,স্বাধীন বাংলাদেশ প্রায় পঞ্চাশ বছর পার করতে চলেছে। জাতির অতীত গৌরবময় পর্বকে নতুন প্রজন্মের সামনে মূর্ত করে তুলে ধরতেই ‘বজ্রকণ্ঠ’ শিরোনামের এই ভাস্কর্য প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করবে নিঃসন্দেহে। একটি দেশের শিল্প- সংস্কৃতিতে ভাস্কর্যও একটি শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ ভাস্কর্য (পাবলিক প্রেস স্কাল্পচার) পৃথিবীর বহুদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক হিসাবে প্রভাব বিস্তার করছে। ‘বজ্রকণ্ঠ’ নামের ভাস্কর্যটিও আমাদের জাতির মানষপটে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারবে, দেশবাসীর মধ্যে দৃঢ়তর করতে পারবে ঐক্যের বন্ধন। বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা ও মুক্তিযুদ্ধের অভিনাসী চেতনাকে ধারণের চিন্তা-চেতনার শিল্পীত রূপকল্পটি বাঙালি জাতি সত্ত¡ার অস্তিত্তের ভিত্তি সোপান। ‘বজ্রকণ্ঠ’ ভাস্কর্যটি নির্মাণ ও স্থাপন কাজে চসিকের ব্যয় হয়েছে ৮৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এর উচ্চতা সাড়ে ২২ ফুট, বেইজসহ (বেদি) পুরো ভাস্কর্যের উচ্চতা ২৬ ফুট। সাদা সিমেন্টের (আর.সি.সি) ঢালাই এর মাধ্যমে ভাস্কর্যটি স্থায়ী রূপপ্রাপ্ত হয়, যার ওজন প্রায় ৩০ টন। এর পূর্বে প্রায় ৪ মাস সময় ধরে মাটি (মডেলিং ক্লে) দিয়ে মূল ভাস্কর্যের আদলটি তৈরী করা হয়েছিল। মাটির তৈরী ওই আদলকে (অনূকৃত) প্রথমে জনসম্মুখে উন্মোচিত করা হয়েছিল। গণমাধ্যমের সংবাদ প্রতিনিধিদের ব্যাপক উপস্থিতিতে এই অনুকৃতির দিনব্যাপী প্রদর্শণী অনুষ্ঠিত হয়, যা ছিল সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। এর মাধ্যমে বরেণ্য প্রথিতযশা বেশ কয়েকজন শিল্পী ও শিল্প- শিক্ষকের মূল্যবান পরামর্শ পাওয়া সহজ হয়েছিল। উক্ত পরামর্শের আলোকে ভাষ্কর্যের মাটির অনুকৃতিকে (আদল) কয়েক দফা পরিমার্জন করে উপরোক্ত পরামর্শমতে শিল্পকর্মটির মাটির মডেলিং সম্পাদন করা হয়েছিল। ‘বজ্রকণ্ঠ’ ভাস্কর্যটির দীর্ঘ স্থায়িত্বকাল নিশ্চিত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর বেদীর (বেইজ) ভূগর্ভস্থ অংশ ও উপরিতলের অংশে রডের কাঠামো এমনভাবে দেয়া হয়েছে যা স্বাভাবিক মাত্রার ভূমিকম্পেও ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। মূল ভাস্কর্যের (আর.সি.সি) ঢালাই ও শক্তিশালী এম.এস রডের কাঠামোর পাশাপাশি কিছু বিশেষ জায়গায় এস.এস রড ব্যবহৃত হয়েছে। দীর্ঘতর সময়কাল স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে পানি, অক্সিজেন ও লবণ ঘটিত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে বিশ্বসেরা কোম্পানী থেকে সংগৃহীত ক্যামিকেল-যৌগ ঢালাই এর মিশ্রণে সুনির্দিষ্ট অনুপাতে মিশানো হয়েছে। এছাড়া কিউরিং (পানিশোষণ প্রক্রিয়া) পর্ব পার করে ভাস্কর্যকে পূর্ণ শুকিয়ে নিয়ে এতে শেওলা প্রতিরোধী ক্যামিকেল স্প্রে (ওয়েদার কোট) ব্যবহার করা হয়েছে। ভাস্কর্যের সলিডিটির অনুভূতিকে বাঁচিয়ে রাখতে ‘ফেয়ার-ফেস’ পদ্ধতিতে এর ঢালাই কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।
উল্লেখ্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের তৎকালীন পরিচালক শিল্পী শায়লা শারমিন এবং নাট্যব্যক্তিত্ব আহমেদ ইকবাল হায়দারের পরামর্শ ও তত্ত¡াবধানে এই ভাস্কর্যকর্ম সৃজিত। এই ভাস্কর্যের ভাস্কর হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ভাষ্কর মোহাম্মদ আতিকুল ইসলাম ভাস্কর্যের নকশা (মডেল) প্রণয়ন থেকে শুরু করে মূল ভাস্কর্য নির্মাণের সার্বিক কর্মকান্ড সম্পাদনা করেন। এই ভাস্কয্য তৈরীতে সহযোগী শিল্পী হিসেবে ছিলেন জয়াশীষ আচার্য্য, তপন ঘোষ ও মোহাম্মদ পারভেজ আলম,শিক্ষার্থী বিলাস মন্ডল, নুর-এ-আলা সিদ্দিক, গোপাল কৃষ্ণ রুদ্র, মোস্তাফিজুর রহমান তোহা, জয়দীপ দেওয়ানজী। এই ভাস্কর্যের অন্যতম একজন সহ-শিল্পী তরুণ ভাস্কর্য তপন ঘোষ এই নামটি নাম ‘বজ্রকণ্ঠ’ প্রস্তাব করেছিলেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সাদাত মোঃ তৈয়ব,সহকারী প্রকৌশলী আনোয়ার জাহান এই ভাস্কর্য নির্মাণের ক্ষেত্রে নানাভাবে অবদান রেখেছেন। তারা এই ভাস্কর্যের বেইজমেন্টের ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং প্রণয়নসহ নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। এছাড়াও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এ ভাস্কর্য বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছেন।