নিজস্ব প্রতিবেদক:: ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে সরিষা চাষে নজর দিয়েছে সরকার। এজন্য ৩ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে প্রায় ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে সরিষা, তিল ও সূর্যমুখী থেকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় মাত্র ৩ লাখ টন। এই উৎপাদন মোট চাহিদার শতকরা মাত্র ১২ ভাগ। বাকি ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে ভোজ্যতেলের যে চাহিদা রয়েছে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে সেই চাহিদার ৪০-৫০ শতাংশ মেটানো হবে সরিষার তেল দিয়ে। আর এই লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে গতবছর থেকেই সরিষার চাষ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কৃষিবিভাগ এরই মধ্যে ১২ লাখ কৃষককে বীজ, সারসহ নানামুখী প্রণোদনাও দিয়েছে, যেন কৃষকরা সরিষা আবাদে আগ্রহী হয়।
কৃষি বিভাগের এই উদ্যোগের প্রভাব পড়েছে মাঠেও। আমন আবাদের পর মাঠ জুড়ে সরিষার আবাদ দেখা যাচ্ছে দেশ জুড়ে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ধানের উৎপাদন না কমিয়েই আগামী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের মধ্যে স্থানীয়ভাবে ১০ লাখ টন তেল উৎপাদন করা হবে, যা চাহিদার শতকরা ৪০ ভাগ। এর ফলে তেল আমদানিতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, সরিষা উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে যেন ধানের আবাদের কোনো ক্ষতি না হয় সে দিকে নজর রাখা হয়েছে। আমন ও বোরো এই দুই ধানের আবাদের মধ্যবর্তী সময়ে সরিষা আবাদ করা হয়। বিনা সরিষা-৯, বিনা সরিষা-১১ ও বিনা সরিষা-১২ এই তিনটি জাত প্রচুর ফলন দেয়। কম সময়ে ফসল তোলা যায়, ৮০ থেকে ৮২ দিনে।
সরকার যে তিন বছরের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তা আগামী বছর শেষ হবে। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে ভিত্তি বছর ধরা হয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছরকে। ঐ বছর ৬ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ করা হয়। আর ২০২২-২৩ প্রথম অর্থবছরে ৮ লাখ ১২ লাখ হেক্টর এবং ২০২৩-২৪ দ্বিতীয় অর্থবছরে ১০ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টরে আবাদ হয়।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রথম বছর সরিষা উৎপাদন শতকরা ৩৩ ভাগ এবং দ্বিতীয় বছর ৭৯.৬৭ ভাগ বৃদ্ধি পাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আবাদ হয় ১০ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর জমিতে। প্রতি হেক্টরে ১ দশমিক ৩৬ টন হিসাবে মোট বীজ উৎপাদন হয়েছে ১৪ লাখ ৯ হাজার টন। এই বীজ দিয়ে ৪ লাখ ৯১ হাজার লাখ টন তেল উৎপাদন সম্ভব। আর প্রতি কেজি ২৩০ টাকা টাকা হিসাবে মোট ১১ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। দুই বছর আগের তুলনায় সাশ্রয় হবে ৫ হাজার কোটি টাকা।
কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, সরিষার উৎপাদন বাড়াতে অনাবাদি চরাঞ্চল, উপকূলের লবণাক্ত, হাওর ও পাহাড়ি অঞ্চলকে তেলজাতীয় ফসল চাষের আওতায় আনা এবং নতুন শস্যবিন্যাসে স্বল্প জীবনকালের ধানের চাষ করা হবে।
বিনার মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৬ হাজার কোটি টাকার সয়ারিন ও পামওয়েল আমদানি করা হয়। সয়াবিন তেলের নামে যা খাই তাতে সয়াবিনের পরিমাণ খুবই কম থাকে। এই তেল খাওয়া নিরাপদও নয়। এ কারণে আমরা ভোজ্যতেলে সয়াবিন নির্ভরতা কমিয়ে সরিষার তেল খাওয়ানোর বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছি। ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষার তেল নিরাপদ। অতীতে সরিষার তেলই খাওয়া হতো।
মানুষের ভোজ্যতেলের অভ্যাস সয়াবিন থেকে সরিষার তেলে পরিবর্তন সম্ভব কি না, এ বিষয়ে এই গবেষক বলেন, আমরা এ নিয়ে কাজ করছি। সাধারণ মানুষকে সরিষা খেতে নানামুখী প্রচারণা কার্যক্রম চালানো হবে।
সরিষার তেলে প্রচুর পরিমাণে এরিউসিক অ্যাসিড থাকে, যা ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়াতে পারে। ইউরিক অ্যাসিডের উচ্চ মাত্রা গাউট এবং কিডনিতে পাথরের মতো সমস্যার কারণ হতে পারে। এমন অভিযোগের বিষয় তিনি বলেন, এটা পুরোপুরি সত্য নয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা সবাই সরিষার তেল খেত। মানুষকে সয়াবিন তেল খাওয়ার জন্য ব্যবসায়ীরা সরিষার তেলের বিরুদ্ধে কথা বলছে বলেন তিনি।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (গবেষণা) ড. আবদুল্লাহ ইউছূফ আখন্দ বলেন, সরিষার ক্ষতিকর দিক হিসেবে যা বলা হচ্ছে তা ঠিক নয়। এই তেলে অনেক গুণাগুন রয়েছে। যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশে সরিষার তেল খাওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে ক্ষতি হচ্ছে এমন কোনো প্রমাণ নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ সরিষা কেন খাচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, সে দেশে প্রচুর সয়াবিন, সূর্যমুখী আবাদ হয়। এ কারণে তারা সেটা গ্রহণ করছে। সরিষা ক্ষতিকর এ কারণে তারা সয়াবিন খাচ্ছে এটা ভুল ধারণা।
যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) গত বছর জানিয়েছে, দক্ষিণ এশীয়রা হৃদযন্ত্রের সক্রিয়তা বজায় রাখতে সহায়তা করে এমন খাদ্য উপাদানের পরিবর্তে ইউরিক এসিড এবং ফ্যাটি এসিডযুক্ত খাবার বেশি গ্রহণ করে থাকে। সরিষার তেলে প্রচুর পরিমাণে ইউরিক অ্যাসিড রয়েছে।
তথ্য বলছে, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশ রান্নার ক্ষেত্রে কতটুকু সরিষার তেল গ্রহণ বা ব্যবহার করা যাবে তার ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তবে ভারতে লিপিড অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া (এলএআই) সরিষার তেলকে হৃদযন্ত্রের জন্য স্বাস্থ্যকর হিসেবে সুপারিশ করেছে।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোবারক আলী বলেন, শীর্ষ কিছু জার্নালে সরিষা তেলের অপকারিতা সম্পর্কে বললেও তারা একই সঙ্গে বলেছে ‘ক্ষতি হতে পারে। তবে ক্ষতি হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ নেই।’ আবার এসব জার্নালে ব্যাবসায়িক প্রপাগান্ডাও থাকে বলেও জানান এই গবেষক।