চট্টগ্রামে ১৩টি আদালত বিচারক শূন্য বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি চরমে

 

- Advertisement -

মো.মুক্তার হোসেন বাবু: চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার প্রায় তেরটি আদালতে বিচারক শূন্যতায় বিচারপ্রার্থীদের চরম ভোগান্তিতে পড়েতে হচ্ছে। ভারপ্রাপ্ত বিচারক দিয়ে কোন রকমে চলছে চট্টগ্রাম আদালত সমূহের বিচার কাজ । দৈনন্দিন আদালত-গুলোতে বিচারক সংকটের কারণে পুরনো মামলার যেমন নিষ্পত্তি হচ্ছে না তেমনি প্রতিদিন নতুন মামলা দায়ের হওয়ায় বাড়ছে মামলার জট । এর ফলে বিচারের অপেক্ষায় ঝুলে থাকা প্রায় ২২ হাজার মামলায় ধুলি জমে গেছে।
এদিকে মামলার জট নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন-বিএইচআরএফ । সংগঠনের পরিচালক (অর্গানাইজিং) এডভোকেট জিয়া হাবীব আহ্সানের তত্ত¡াবধানে চট্টগ্রাম শাখার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এডভোকেট এ.এইচ.এম জসীম উদ্দিনের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের একটি তথ্যানুসন্ধানী টিম কর্তৃক প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদনে উক্ত বিচারক সংকটের করুন চিত্র তুলে ধরা হয়। টিমের অপর সদস্যগণ হচ্ছেন যথাক্রমে মানবাধিকার মিডিয়া সেল কর্মী কে.এম. শান্তনু চৌধুরী, মানবাধিকার কর্মী মোহাম্মদ রিদুয়ান করিম নাভিল ও মোহাম্মদ জিয়াউদ্দীন আরমান ।

প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, কোন না কোন আদালতে দীর্ঘদিন ধরে বিচারক শূন্যতার কারণে ন্যায় বিচার এবং বিচার প্রার্থী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে । দূর-দূরান্ত এবং দুর্গম এলাকা থেকে আগত বিচার প্রার্থী জনগোষ্ঠী বিচারক না থাকায় শুধুমাত্র হাজির হয়ে তারিখ পরিবর্তনে বিদায় নিতে হয়, যা খুবই দুঃখজনক ।
অপরদিকে আদালত-গুলোতে জটে আটকে পড়া মামলার সংখ্যাকে আনুপাতিক হারে হিসাব করলে দেখা যায়, সেখানে প্রয়োজন আর কিছু সংখ্যক নতুন আদালত । এক সময় যখন ৯০ টি আদালতের মধ্যে প্রায় ২১টি আদালত ছিল বিচারক শূন্য তবে বর্তমানে ৯০ টি আদালতের মধ্যে প্রায় ১৪ টি গুরুত্বপূর্ণ আদালতে থমকে আছে বিচারক সংকটে । ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে নতুন আদালত সৃষ্টির পাশাপাশি শূন্য আদালতে আরো বিচারক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন ।
জানা গেছে, বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে চট্টগ্রাম বিভাগের দুর্নীতি ও চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বর্তমানে আদালতটিতে বিচারাধীন রয়েছে প্রায় ৭শ’র অধিক মামলা । দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা প্রায় আড়াইশ মামলার বিচার চলছে । অথচ বিশেষ এই আদালতে এখন চলছে বিচারক সংকট । গত ৭ জানুয়ারি এই আদালতের বিচারক রুহুল আমিন বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন । বিভাগীয় দ্রæত বিচার ট্রাইব্যুনাল (জেলা জজ) ও দ্রæত বিচার আদালত অত্যন্ত গুরত্বপুর্ণ একটি আদালত যেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে অন্যান্য আদালত থেকে চাঞ্চল্যকর মামলা সমূহ দ্রæত নিস্পত্তির জন্য বদলী করা হয় । বর্তমানে এই ট্রাইব্যুনালে ও বিচারক শুন্য থাকায় প্রায় ১শ’র বেশি গুরুত্বপূর্ণ চাঞ্চল্যকর মামলা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে । ২০১৭ সালের ২ ফেব্রæয়ারী বিভাগীয় দ্রæত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোঃ মহিতুল হক এনাম চৌধুরীকে সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে বদলি করার পর থেকে এই আদালতের বিচারক সংকট শুরু হয়। দীর্ঘদিন ধরে বিচারক শূন্য থাকার পর গত বছরের ফেব্রæয়ারি মাসে দ্রæত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারক হোসনে আরা বেগমকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয় আইন মন্ত্রণালয়। কিন্তু কাজে যোগ না দিয়ে তিনি অন্য জায়গায় বদলি হয়ে চলে যান। পরবর্তীতে আবার গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর নরসিংদীর জজ আদালত হতে বিচারক মোজাম্মেল হক চৌধুরীকে উক্ত ট্রাইব্যুনালে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় । কিন্তু তিনি মাত্র দুই মাস কাজ করার পর গত বছরের নভেম্বরে অন্যত্র বদলি হয়ে যান । এরপর থেকে দ্রæত বিচার ট্রাইব্যুাল বিচারক শূন্য আছে। অপরদিকে দীর্ঘদিন যাবৎ চট্টগ্রামে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত ও পারিবারিক আদালতে বিচারক শূন্য থাকায় বিচারের অপেক্ষায় ঝুলে ছিল সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশী মামলা এতে করে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় সকল মামলার পক্ষগণকে। কিন্তু বর্তমানে ৭টি নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ দেওয়ায় বিচারপ্রার্থীদের দূর্ভোগ কমতে শুরু করেছে । পারিবারিক এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলাগুলো ১৮০ দিনের মধ্যে মামলার বিচারকাজ শেষ করার আইনী বিধান রয়েছে কিন্তু বিচারক সংকট থাকায় তা উপেক্ষিত হয়ে আসছে । বিভিন্ন আদালতে বিচারক না থাকায় দিনের পর দিনে মামলার ৩/৪ মাস পর পর তারিখ পড়তে থাকে । একই সাথে প্রতিদিন নতুন নতুন মামলা দায়ের হওয়ায় মামলার জট আরও বেড়ে যাচ্ছে । ফলে নতুন তারিখ নির্ধারণ করেই মামলা রেখে দেয়া হয়। এতে পুরানো মামলা যেমন নিস্পত্তি হয়নি তেমনি প্রতিদিন নতুন মামলা যোগ হওয়ায় বেড়েছে জট ।
বিভাগীয় স্পেশাল জজ (জেলা জজ) আদালত এবং বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল (জেলা জজ) ছাড়াও চট্টগ্রামের আরও ১২ টি আদালতে রয়েছে বিচারক সংকট । তার মধ্যে জেলা জজশিপের অধীনে ৩য়, ৬ষ্ঠ এবং ৭ম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতগুলোতে রয়েছে বিচারক সংকট । জেলা জজশিপের অধীনে দেউলিয়া আদালত, ১ম অতিঃ ও শিশু আদালত ২য়, ৩য় এবং ৪র্থ অতিঃ মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং চীফ জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অধীনে ২য় ও ৫ম জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে বিচারক নেই । এই ১৪টি আদালতে রয়েছে প্রায় ২২ হাজার বিচারধীন মামলা । এর মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ সংকট নিরসনে জরুরী ভিত্তিতে আইনজীবীদের থেকে ল’ইয়ার ম্যাজিস্ট্রেট বা জজ নিয়োগের সুপারিশ পেশ করা হয় ।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয় , চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরীর বিশাল এলাকা একটি মাত্র অর্থঋণ আদালত দিয়ে বহু কষ্টে চলছে । এক সময় চট্টগ্রামে ৪/৫টি বাণিজ্যিক আদালত ও অর্থ ঋণ আদালত থাকলেও বর্তমানে একটি মাত্র আদালত থাকায় ব্যাপক মামলা জট সৃষ্টি হয়েছে । ফলে আদালতের কার্যক্রমে মামলার পরবর্তী তারিখ ২/৩ মাসের আগে হয় না । অথচ ৬ মাসে এ মামলা শেষ করতে হয় ।
চট্টগ্রামের ২য় অর্থ ঋণ আদালত হল চট্টগ্রাম জেলার সবচেয়ে ব্যস্ত আদালত ১ম জেলা ও দায়রা আদালত । ফলে খেলাপী গ্রাহকদের পোয়াবারো অবস্থা ও ব্যাংকগুলোর ত্রাহি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে । অধিকিন্তু একটি মাত্র আদালত ও সেরেস্তা থাকায় ব্যাংক ও ব্যাংকের পক্ষে নিযুক্তীয় কৌঁসুলিগণ পেশকার ও সেরেস্তাদারের নিকট জিম্মি হয়ে আছে। বাণিজ্যিক রাজধানীর ব্যাংকগুলোকে খেলাপী ঋণের গ্রাস থেকে রক্ষা করতে হলে ঢাকার চট্টগ্রামেও অন্ততঃ আর ৩/৪টি অর্থ ঋণ আদালত স্থাপন অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে । এখানে কমপক্ষে ৫টি অর্থঋণ আদালত স্থাপনের সুপারিশ করেছেন।

সর্বশেষ