মো.মুক্তার হোসেন বাবু :: করোনা ভাইরাস মহামারীর শুরু থেকে অর্থাৎ মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে অগ্রগতি হয় পাঁচ শতাংশ। করোনা সংকটের শুরুতে প্রায় ৩০০ চীনা নাগরিক ছুটিতে নিজ দেশে অবস্থান করছিল। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে তারা বাংলাদেশে ফিরে আসে এবং কোয়ারেন্টিন পিরিয়ড শেষ করে কাজে যোগ দেয়। করোনাকালের প্রথমদিকে সীমিত পর্যায়ে কাজ চললেও টানেলের খনন কাজ বন্ধ হয়নি। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে এগিয়ে গেছে খনন কাজ। গত বুধবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের টানেল নির্মাণের অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় জানান, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেলের দুটি টিউবের মধ্যে একটির খনন ও রিং স্থাপন কাজ শেষ হয়েছে। আরেকটি টিউবের খনন কাজ আমরা আশা করি নভেম্বর মাসে শুরু করা যাবে। টানেলের সার্বিক অগ্রগতি প্রায় ৫৮ ভাগ। তিনি জানান, প্রকল্পের প্রায় ৫৮ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।
জানা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় পাতাল পথ বঙ্গবন্ধু টানেলের (কর্ণফুলী টানেল) মোট দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৪০০ মিটার বা ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। এরমধ্যে টিউবের দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৪৫০ মিটার। কর্ণফুলী নদীর নিচে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় দুটি টিউব বসানোর মাধ্যমে টানেলটি নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিটি টিউব চওড়ায় হবে ৩৫ ফুট এবং উচ্চতায় গ্রায় ১৬ ফুট। টিউব দুটির একটি দিয়ে শহর থেকে গাড়ি প্রবেশ করবে। আরেকটি টিউব দিয়ে ওপার থেকে গাড়ি প্রবেশ করবে। নদীর তলদেশে ৯৪ মিটার দীর্ঘ ২২ হাজার টন ওজনের টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) দিয়ে চলছে খননের মূল কাজ। প্রতিদিন অল্প অল্প করে এগিয়ে চলছে টানেলের নির্মাণ কাজ। ইতিমধ্যে একটি টিউবের বোরিং ও রিং লাগানোর কাজ শেষ হয়েছে। নির্ধারত সময় ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার আশা করছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি)।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ট্যানেলের টিউব তৈরি করে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারায় গিয়ে শেষ হয়েছে। সেখান থেকে আরেকটি টিউবের বোরিং কাজ শুরু করে আবার পতেঙ্গায় আসবে। নির্মিত টিউবে এবার সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হবে। প্রতিদিন সাত থেকে আটটি করে রিং লাগনো হয়েছে টানেলের টিউবে। ৩৫ ফিট চাওড়া ও দুই মিটার দৈর্ঘ্যরে রিং ক্রমান্বয়ে বসানোর মাধ্যমে কর্ণফুলী টানেলের একটি টিউবের কাজ শেষ হয়েছে। বোরিং ও রিং বসানোর কাজ শেষ হওয়া টিউবে এখন শুরু হচ্ছে রাস্তার কাজ। গোলাকৃতির টিউবটিকে এবার রাস্তার রূপ দেয়া হবে। এর মাধ্যমে চলাচলের উপযোগী হয়ে উঠছে টানেল। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, সার্বিকভাবে প্রকল্পের প্রায় ৫৮ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। একটি টিউবের কাজ শেষ হয়েছে। এখন টিবিএম মেশিনটা আনোয়ারা অংশ থেকে আবার টার্ন করবে। সেটা তিন-চার মাসের মতো সময় লাগবে। সবগুলো জিনিস খুলে আবার লাগাতে হবে। সেখান থেকে আরেকটি টিউবের খনন কাজ শুরু হয়ে পতেঙ্গার দিকে আসবে।
তিনি জানান, পৃথক দুটি টিউবে নির্মিত হবে টানেল। প্রতি টিউবে দুই লেন করে চার লেনে গাড়ি চলাচল করবে। জরুরি মুহূর্তে এক টিউব থেকে অন্য টিউবে যাতায়াত করতে দুই টিউবের সঙ্গে পৃথক তিন স্থানে সংযোগ সড়ক থাকবে। এখন টিবিএম মেশিনটি টিউব তৈরি করে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারায় গিয়ে শেষ হয়েছে। সেখান থেকে আরেকটি টিউবের বোরিং কাজ শুরু করে আবার পতেঙ্গায় আসবে। বোরিং করা টিউবে রিং বসানো হয়েছে। এবার রিং করা টিউবে দুই লেনের সড়ক তৈরির কাজ শুরু হবে। অন্যদিকে আনোয়ারা অংশে টিবিএম মেশিনটি আবার সংযোজন করে বোরিংয়ের মাধ্যমে পতেঙ্গার দিকে রওনা হবে। সে টিউবেও দুই লেনের আরো একটি সড়ক হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কর্ণফুলী টানেলের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা শেষ হয় ২০১৩ সালে। চার বছর মেয়াদকালের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। ২০১৪ সালের ১০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বেইজিংয়ে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। পরে ২০১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর সিসিসিসির সঙ্গে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের চুক্তি হয়। ২০১৫ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারি সিসিসিসি বাণিজ্যিক প্রস্তাব দাখিল করে। বাণিজ্যিক প্রস্তাবের পর কারিগরি দিক পরীক্ষায় দুজন বিদেশি ও একজন দেশি পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ৩০ জুন সিসিসিসির সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সর্বশেষ ৬ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে লোন কার্যকরে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রকল্পে ঋণ হিসেবে চাইনিজ এক্সিম ব্যাংক ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকার অর্থায়ন করছে। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকার ব্যয় করবে।
প্রকল্প সংশ্লষ্টরা জানান, রাস্তার কাজও চলমান আছে। পুকুর, বিভিন্ন স্থাপনা এসব কিছু ঠিক করতে হচ্ছে। সেগুলোও চলমান আছে। টিউবের ভিতর এখন গোলাকৃতির। সেটার ভিতরের জিনিসপত্র বের করার পর সেখানেও রাস্তা নির্মাণের কাজ করা হবে। এগুলো করতে কিছুটা সময় লাগবে।
জানা গেছে, মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে ২০০৮ সালে লালদীঘির ময়দানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের ঘোষণা দেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে টানেল নির্মাণের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকন কোম্পানির (সিসিসিসি) সঙ্গে চুক্তি সই হয়। গত বছরের ২৪ ফেব্রæয়ারি কর্ণফুলী টানেলের খনন কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন তিনি টানেল প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড পরিদর্শন করেন। ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে এ টানেলটি পতেঙ্গার নেভাল অ্যাকাডেমি পয়েন্ট থেকে শুরু হয়ে কাফকো ও সিইউএফএল পয়েন্টের মাঝখান দিয়ে কর্ণফুলী নদীর ওপারে গিয়ে উঠবে। এ প্রকল্পের অধীনে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার টানেল নির্মাণের পাশাপাশি টানেলের পূর্ব (আনোয়ারা) প্রান্তে ওপেন কাট ২০০ মিটার, কাট অ্যান্ড কভারের ১৯৫ মিটার, অ্যাপ্রোচ রোড ৫৫০ মিটার এবং ২৫ মিটার ওয়ার্কিং শ্যাফট নির্মাণ করা হবে। অন্যদিকে টানেলের পশ্চিম (পতেঙ্গা) প্রান্তে ওপেন কাট ১৯০ মিটার, কাট অ্যান্ড কভারের ২৩০ মিটার, অ্যাপ্রোচ রোড ৪ হাজার ৭৯৮ দশমিক ০৯৫ মিটার এবং ২৫ মিটার ওয়ার্কিং শ্যাফট নির্মাণ করা হবে। টানেলটি চট্টগ্রাম নগরকে কর্ণফুলী নদীর অপর অংশের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করবে। ফলে কর্ণফুলী নদীর দুই পাশে নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। পরোক্ষভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাধ্যমে সারাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এতে কক্সবাজারের সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার কমে যাবে। এটি ভবিষ্যতে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে।