২০০৭-০৮ সালে ওয়ান-ইলেভেনে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মার্কিন সরকারের নীতি এবং ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ভূমিকায় বিরাট ভুল ছিল বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক মার্কিন কূটনীতিক জন এফ. ড্যানিলোভিচ।
মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির অতীতের ত্রুটি স্বীকার করে তিনি বলেন, ওয়ান-ইলেভেন রাজনৈতিক সংকটের সময় মার্কিন সরকার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর যথেষ্ট মনোযোগ দেয়নি। তবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের সমর্থনে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছে।
শনিবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত “ঢাকার এক নতুন ভোর: গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কের গতিশীলতা নেভিগেট করা” শীর্ষক আলোচনায় ড্যানিলোভিচ বক্তব্য রাখছিলেন।
সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনায় বাংলাদেশে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি. মাইলামও অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশে বিভিন্ন বিদেশী মিশনের কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী নেতা, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের সদস্য, সাংবাদিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
ড্যানিলোভিচ জোর দিয়ে বলেছেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের কৃতিত্ব কেবল বাংলাদেশের জনগণের। কারণ এই আন্দোলনটি সম্পূর্ণরূপে স্বদেশেই সৃষ্ট হয়েছিল। যার ফলে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন।
তিনি বলেন ‘এতে (অভ্যুত্থান) এমন কিছু ছিল যা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছিল। এটি বাংলাদেশে উত্থিত হয় এবং বাংলাদেশেই সফল হয়। পূর্ববর্তী স্বৈরশাসনের অবসান এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এই চতুর্থ সুযোগের জন্য কেবল বাংলাদেশের জনগণই কৃতিত্বের দাবিদার’।
পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, ড্যানিলোভিচ বলেন, সিদ্ধান্তটি কেবল বাংলাদেশের জনগণের উপর নির্ভরশীল।
তিনি বলেন ‘এটি এমন একটি প্রশ্ন যার উত্তর বাংলাদেশের জনগণকে দিতে হবে। আমি স্বীকার করি, আমার কাছে, এটিই বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন’।
জবাবদিহিতার বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণই জবাবদিহিতার একমাত্র পরিমাপ নয়। ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রক্রিয়া এবং ব্যক্তিদের জবাবদিহি করার জন্য আইনি ব্যবস্থাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’।
রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি. মাইলাম এবং ড্যানিলোভিচ বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং এদেশের গণতান্ত্রিক উন্নয়নকে সমর্থন দিতে আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব এবং নীতিগত পদ্ধতির গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন।
মাইলাম বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, তারা আমেরিকান জনগণকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পথ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য একটি ছোট সংগঠন গঠন করেছেন। গত পাঁচ বছরে তারা তহবিল সংগ্রহ করেছেন এবং এই উদ্যোগকে সমর্থন করে চলেছেন।
আবার বাংলাদেশ সফরে আসার আনন্দ প্রকাশ করে মাইলাম বলেন, ভিসা বিধিনিষেধের কারণে তিনি গত এক দশক ধরে এদেশ ভ্রমণ করতে পারেননি।
ড্যানিলোভিচ গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার ওপর জোর দিয়ে বলেন, ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন নীতির ধারাবাহিকতা রয়েছে।
তিনি বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলগুলোর মধ্যে জবাবদিহিতার অভাবকে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে একটি হিসেবে চিহ্নিত করেন।
তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য শক্তিশালী বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কর্তৃত্ববাদী শাসন কখনই গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য সহায়ক নয়’।
তিনি আরও মন্তব্য করেন যে, বাংলাদেশ বর্তমানে একটি ‘তথ্য যুদ্ধ’ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এবং মার্কিন সরকার মিডিয়া-চালিত ভুল তথ্য মোকাবেলায় সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
তিনি বাংলাদেশের নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য মার্কিন অর্থায়ন সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অস্থিতিশীল করার চেষ্টাকারী গোষ্ঠীগুলির দ্বারা প্রচারিত বিভ্রান্তিকর প্রচেষ্টা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার মার্কিন সামরিক তৎপরতা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে ড্যানিলোভিচ এই ধরনের দাবিকে বিদ্বেষপূর্ণ উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে দেয়া ভিত্তিহীন গুজব বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারকে তাদের দুর্নীতি ও অনিয়ম ঢাকতে বিদেশী দেশগুলির বিরুদ্ধে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগও করেন।
ড্যানিলোভিচ জোর দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত তাদের তহবিল নীতিগুলিকে বাংলাদেশের চলমান সংস্কারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা।
তিনি একটি সক্রিয় নাগরিক সমাজের প্রয়োজনীয়তার উপরও জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের উচিত গত ১৭ বছরে বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার করা এবং প্রশাসন সংস্কারে সেগুলি ব্যবহার করা।
আলোচনায় প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে জবাবদিহিতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশী প্রবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উপরও আলোকপাত করা হয়।
উভয় বক্তা গণতন্ত্রে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উপর জোর দেন। ড্যানিলোভিচ বলেন,‘গণতান্ত্রিক আলোচনাকে শক্তিশালী করতে গণমাধ্যমের প্রভাবকে উপেক্ষা করা যায় না এবং নাগরিক সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করা উচিত’।
প্রশ্নোত্তর পর্বে রাষ্ট্রদূত মাইলাম এবং ড্যানিলোভিচ ছাত্র, রাজনীতিবিদ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের প্রশ্নের উত্তর দেন। তারা বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক এবং দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন।